কাশ্মীর নিয়ে প্রতিদিন ছায়াযুদ্ধ চলছেই। আবার নতুন করে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হল। তবে এবার যুদ্ধ ক্ষেত্রে নয়। এবার ফের জল নিয়ে শুরু হল ভারত পাকিস্তান বাগ যুদ্ধ। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই উভয়ের বিরুদ্ধে জল চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।
পাকিস্তানের আর্থিক রাজধানী করাচির একটি জনবহুল ও অবহেলিত অঞ্চলের নারী ও শিশুদের প্রতিদিন জলের সন্ধানে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়। পাকিস্তানের প্রায় সব শহরেই এই দৃশ্য প্রতিনিয়ত দেখা যায়। সরকারি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশটির সীমান্ত এলাকার প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষের বাড়িতে খাবার জলের সরবরাহ নেই। এবং ৭০ শতাংশ জলই দূষিত।
নদী ও জলাধারগুলো শুকিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসছে এই জল সংকট। ১৯৬০-এর দশকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার ছয়টি নদীর জলের যৌথ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ইন্দাস ওয়াটার্স ট্রিটি স্বাক্ষরিত হয়। এখন ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই উভয়ের বিরুদ্ধে এই চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সর্বশেষ বিরোধ সৃষ্টি হয় চেনাব নদীতে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে। পাকিস্তান বলছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত ইন্দাস ওয়াটার্স ট্রিটি লঙ্ঘন করছে। একই সঙ্গে এই প্রকল্পের মাধ্যমে জলের সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও অভিযোগ তোলে পাকিস্তান।
আরও পড়ুনঃ সীমান্তের কাঁটাতার অগ্রাহ্য করে একদিনের জন্য এক হল ভারত বাংলাদেশ
আরও পড়ুনঃ জয় হিন্দ, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের সোনার অক্ষরে লেখা ইতিহাস
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই প্রকল্প পরিদর্শনে পরিদর্শক পাঠানোর কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন। পাক পরিদর্শকদের সেখানে যাওয়ার ও রিপোর্ট দেবার কথা সরকারকে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনার কাজ চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই সংকট কীভাবে নিরসন হবে, তা এখনও অস্পষ্ট।
ওয়াশিংটনের উইড্রো উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহযোগী মাইকেল কাগেলম্যান জানান, জলকে ঘিরে ভারত-পাক উত্তেজনা নিঃসন্দেহে আরও তীব্র হয়ে উঠবে এবং এর ফলে ইন্দাস ওয়াটার্স ট্রিটি বা জলচুক্তি খেলাপের মুখে পড়বে।
আপাতত ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্থিতিশীল ও ইতিবাচক দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানে প্রায় ছয় মাস আগে ক্ষমতায় আসা ইমরান খান সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীও এতে সমর্থন দিচ্ছে। নয়াদিল্লি কিছুটা সংশয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেছে।
তারপরও দেশ দুটির মধ্যে বিরোধের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি রয়ে গেছে। ইমরান খান দুটি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে একটি বাঁধ নির্মিত হবে বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে। জলের বিষয়টির কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর গত বছরের শেষেই সাংবাদিকদের জানান, ‘ভবিষ্যতে যদি কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তবে তা এই ইস্যুতেই হবে। আমাদের বিষয়টির প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন’।
আরও পড়তে পারেনঃ ভারতকে চাপে রাখতে পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ দিচ্ছে চিন
আরও পড়তে পারেনঃ চিনের জন্য নিজেদের মাথার চুল কাটছে পাকিস্তানের নারী পুরুষ
সুইডেনের আপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অশোক সোয়েন জানান, যদি মোদী পুনরায় নির্বাচিত হন, তবে পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তিনি জলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন। তিনি হয়ত ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই তা করবেন না। যদি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়, তবে ২০২০-২১ সালের মধ্যেই জলকে ব্যবহার করে পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন মোদী, বলছে আন্তর্জাতিক মহল।
বিশ্বের সংস্থাগুলো অনুমান করছে, বিশ্বের বৃহত্তম হিমবাহ থাকা সত্ত্বেও ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যাপক জল সংকটে পড়বে পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, এরই মধ্যে দেশটির মাথাপিছু জলের প্রাপ্যতা ১৯৯১ সাল থেকে এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, জল সংকট নিয়ে পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এদিকে নয়াদিল্লির সরকারি নীতি আয়োগের মতে, ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতে জলের চাহিদা বর্তমান জল সরবরাহের দ্বিগুণে দাঁড়াবে। জল সংকট সমাধানে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।
আরও পড়ুনঃ দাউদ ইব্রাহিমকে হত্যার পরিকল্পনা করায় ডি কোম্পানির হাতে পাকিস্তানে খুন
আরও পড়ুনঃ পৃথিবী জুড়ে কমছে শিশু, চরম সমস্যায় বিশ্ব সমাজ
কিন্তু ১৯৬০ সালের জল চুক্তির পর এই সমস্যা সমাধানে আর বিশেষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। দুই পক্ষের কর্মকর্তারাই বলছেন, বিষয়টি নিয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভারতের কেন্দ্রীয় ওয়াটার কমিশনের চেয়ারম্যান এস মাসুদ হুসেন জানান, ‘আমরা সংকটের দ্বারপ্রান্তে আছি। আমাদের জলের উৎসগুলোর সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন’।
যে ভাবে বিতর্ক বাড়ছে তাতে কাশ্মীরের পাশাপাশি ভারত-পাক পরের যুদ্ধটা জল নিয়েই হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। আর এই নিয়েই উদ্বেগ বাড়ছে রাষ্ট্রসংঘেও।