মিডিয়া ট্রায়াল, তদন্তের আগেই নিজের রায় ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই

706
মিডিয়া ট্রায়াল, তদন্তের আগেই নিজের রায় ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই
মিডিয়া ট্রায়াল, তদন্তের আগেই নিজের রায় ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই

মিডিয়া ট্রায়াল, তদন্তের আগেই নিজের রায় ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। “বিচারাধীন মামলায় মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করুন”, বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সত্যি বাংলায় এত ‘ট্রায়াল’ হয়, যে বলার নয়। একটার পর একটা ঘটনার কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে, তবু শেষ হবে না। আজ প্রথমবার আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। তদন্ত চলছে, আদালতে মামলা চলছে, তাও আগেভাগেই ‘রায়’ ঘোষণা করে দেওয়াটা বাংলায় একটা পুরনো রোগ। যার নাম ‘ট্রায়াল।

১. ফেব্রুয়ারি ২০১২, পার্ক স্ট্রিট গণ’ধর্ষ’ন। কলকাতা পুলিশের রিপোর্টেই ছিল, পার্ক স্ট্রিটে ধ’র্ষ’ণ হয়েছিল। খোদ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান, সেই রিপোর্ট জানিয়েছিলেন। দিন দশেক পর পুলিশি তদন্ত চলাকালীন, কে যেন মহাকরণে দাঁড়িয়ে ‘ট্রায়াল’ করে দিল, ‘‘সাজানো ঘটনা। সরকারকে ম্যালা’ইন করার জন্য এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। সব বের হবে”। অন্যদিকে সেদিনই কলকাতা পুলিশের তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দময়ন্তী সেন বলেছিলেন, “ধ’র্ষ’ণ হয়েছে”। দময়ন্তী সেনকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে, পাঠানো হয়েছিল গুরুত্বহীন পদে। কারণ সেদিন ‘পুলিশের রিপোর্ট’ আর ‘ট্রায়াল রিপোর্ট’ মেলেনি।

২. সেপ্টেম্বর ২০১৮, উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের দাঁড়িভিট হাইস্কুলে গু’লি চলে। মা’রা যায় রাজেশ সরকার নামে এক ছাত্র। পড়ুয়াদের অভিযোগ ছিল, স্কুলে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকের অভাব রয়েছে। কিন্তু নবনিযুক্ত শিক্ষকরা সব উর্দু ভাষার। পড়ুয়াদের দাবি ছিল, ওই স্কুলে উর্দুর ছাত্র-ছাত্রীই নেই। স্কুল চত্বরে পুলিশ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রবল সং’ঘর্ষে গু’লিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু রাজেশের। তদন্ত চলাকালীন কে যেন ‘ট্রায়াল’ করে দিল, “পুলিশ গুলি চালায়নি”।

৩. সেপ্টেম্বর ২০১৮, ভেঙে পড়ল মাঝেরহাট ব্রিজ। তিনজনের মৃত্যু। পরেরদিন ঘটনাস্থলে পৌঁছেই হয়ে গেল ‘ট্রায়াল’, “দায়ী মেট্রো রেলের কাজ”। অনেক পরে নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে জানা জয়, “ট্রায়াল ভুল ছিল, গাফিলতি পূর্ত দফতরের। তদন্তের ঘোষণা হল। তদন্ত শেষ হবার আগেই আবার ‘ট্রায়াল’, “পূর্তমন্ত্রীর কাছে কোনও ফাইলই পাঠানো হত না, মেট্রোর তরফে”।

৪. জুলাই, ২০১৭, বাদুড়িয়া, বসিরহাট লাগোয়া বিস্তীর্ণ জায়গায় সা’ম্প্রদা’য়িক উত্তেজনা। তদন্ত, পুলিশের রিপোর্ট পৌঁছানোর আগেই ‘ট্রায়াল’, “একটা ছোট জায়গায় গোলমাল হয়েছে। এত ভাববার কিছু নেই। ২-৩টি ছোট ব্লক এলাকার গোলমাল”।

৫. জুন ২০১৬, নারদ স্টিং অপারেশনের তদন্ত কলকাতা পুলিশকে দিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা। পরের দিন প্রকাশ্যে ‘ট্রায়াল’, “সব চক্রান্ত, আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে, টেবিলে টাকা রেখে ছবি তুলে বলছ ঘুষ নিয়েছে। তাহলে কী কারও সঙ্গে দেখা করা যাবে না? এই ভাবে ব্ল্যাক’মেলের চেষ্টা চলছে”।

৬. জুন ২০১৩, কামদুনি নৃ’শংস ধ’র্ষ’ণ, এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। চাকরির প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়েও বিক্ষোভে ফেঁসে সেই ‘ট্রায়াল’, ‘‘চোপ। সব সিপিএম, সব মাও’বাদী, আমাকে খু’ন করার চক্রান্ত হয়েছিল”। ‘ট্রায়ালে’ প্রতিবাদী গ্রামবাসীরা হয়েছিলেন, ‘সিপিএম’ এবং ‘মা’ওবাদী’।

৭. ফেব্রুয়ারি ২০১২, বর্ধমানের কাটোয়ায় চলন্ত ট্রেনে কিশোরী মেয়ের সামনে এক মহিলাকে গণ’ধর্ষ’ণের ঘটনা। সেদিনই ‘ট্রায়াল’, ‘ছোট ঘটনা, এতকিছু হয়নি’।

৮. আগস্ট ২০১২, বেলপাহাড়িতে জনসভা। সভায় যোগ দিয়েছিলেন শিলাদিত্য চৌধুরি। ফসলের দাম নিয়ে অভিযোগ জানানোয়, ‘ট্রায়ালে’ তাঁকে ‘মাও’বাদী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পুলিশের হাতে গ্রেফতার, ১৪ দিনের জেল হেফাজত। পরে হাইকোর্টে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয় রাজ্য সরকার।

৯. এপ্রিল ২০১২, কার্টুন কান্ড। অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ফেসবুকে একটি কার্টুন পোস্ট করায়, তা ‘খু’নের চক্রান্ত’ হিসাবে বর্ণনা করে হয়েছিল ‘ট্রায়াল’। অধ্যাপকের বাড়ি আক্র’মণ করে শাসক দল। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন অধ্যাপক। বহু বছর পরে, হাইকোর্টের নির্দেশে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে, মুখ পুড়িয়েছিল রাজ্য সরকার। সঙ্গে দুই পুলিশ কর্তা সাসপেন্ড। সব ওই ‘ট্রায়াল’ শুনে কাজ করতে যাওয়ার ফল।

১০. মে ২০১০, বাম শাসন। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা। ১৪৯ জনের মৃত্যু। পরেরদিন ‘ট্রায়াল’, “গভীর ষড়’যন্ত্র, সিপিএমের হাত আছে”। জ্ঞানেশ্বরী ‘ষড়’যন্ত্রের’ সিবিআই তদন্ত করিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। সিবিআই চার্জশিটে ‘স্যবোটাজ’ বলা হলেও, ‘সিপিএম-র চক্রান্ত’-র তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়েছিল সিবিআই। নৃশং’স সেই ঘটনার পান্ডা বলে যারা চিহ্নিত হয়েছিল, তাদের বেশ কয়েকজন ছিল বর্তমান শাসক দলের কর্মী, যেমন উমাকান্ত মাহাতো।
আরও কত কত ‘ট্রায়ালের’ স্বাক্ষী এই বাংলা। বলেছিলাম না, তদন্ত চলাকালিন ‘ট্রায়ালের’ কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে…১০টা নয় এমন ১০০টা ‘ট্রায়ালের’ খবর লিখতে পারি। তাই বলি, কখনও বিচারের আগেই ‘ট্রায়াল’ করাটা একদম ঠিক নয়…একদম ঠিক কথা বলেছেন আমাদের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, “মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করুন”।

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন