The News বাংলা: মঙ্গলবারই রায় হয়েছে, ২০০২ সালে গুজরাটে ‘গুলবার্গ গণহত্যা’য় নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে করা অভিযোগ আবার শুনবে সুপ্রিম কোর্ট। আর সেই সময় যে ‘দাবাং’ পুলিশ অফিসার একা মোদী ও গুজরাট রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তিনি প্রাক্তন আইপিএস সঞ্জীব ভাট।
আইপিএস সঞ্জীব ভাট নামটা নিশ্চয়ই শোনেন নি? ভারতের এই তুখোড় আইপিএস অফিসার ১৯৮৭-৮৮ সালে ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আইপিএস হয়ে মাত্র ২৩ বছর বয়সে গুজরাতে পুলিশ অফিসারের পদে যোগদান করেন।
অভিযোগ, ২০০২ সালে গোধরা কান্ডের পর যখন গুজরাতের পুলিশ প্রশাসন ‘সন্ত্রাসবাদী’দের উন্মত্ততার বিষয়ে মৌণতা অবলম্বন করে চলছিলেন, তখন এই দাপুটে পুলিশ অফিসার সমস্ত ভয়-ভীতিকে তুচ্ছ করে সমস্ত সরকারি মেশিনারির বিরুদ্ধে একাই দাঁড়িয়ে সরকারের ‘গুন্ডাগিরি’র গোপন কথা ফাঁস করেছিলেন।
আরও পড়ুন: ‘গুজরাট দাঙ্গা’, মোদীর বিরুদ্ধে জাকিয়ার অভিযোগ শুনবে সুপ্রিম কোর্ট
যার বয়ানের উপরে নির্ভর করে আদালত এবং বিভিন্ন কমিশন ২০০২ সালে গুজরাটের ‘নরসংহারে’ সরকারের নির্দেশে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের তৎকালীন রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। যদিও তাঁর কোন অভিযোগই আদালতে টেকে নি, তাঁকে আইপিএস পদ থেকেও বহিস্কার করা হয়।
২০০৬ সালে সাংসদ এহসান জাফরী-এর বিধবা স্ত্রী জাকিয়া জাফরি ‘গুলবার্গ গণহত্যা’ নিয়ে তাঁর আবেদনে এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে এই ‘দুঁদে’ আইপিএস সঞ্জীব ভাটের নাম দেন। কিন্তু গুজরাট পুলিশ জাকিয়া জাফরির এফআইআর নিতে অস্বীকার করে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট-এ জাকিয়া জাফরির মামলা নথিভুক্ত হয় (কেস নং- এসএলপি ১০৮৮), এই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় সিট বা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম এর উপরে।
এই ‘দাবাং’ পুলিশ অফিসার সঞ্জীব ভাট নিজের জীবনের পরোয়া না করে সিট বা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম এর সামনে এবং সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে মোদীর বিপক্ষে স্বাক্ষ্য দেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, এহসান জাফরি-কে তৎকালীন গুজরাট সরকার পরিকল্পনা করে ‘ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী’দের দ্বারা জ্বালিয়ে হত্যা করেছিল।
শুধু সেটাই বলেননি, তিনি ২০০২ সালে ‘গুজরাট নরহত্যা’য় সরকারের ভূমিকা নিয়েও অভিযোগ করেন এবং সন্ত্রাসবাদী সরকার ও তার প্রশাসনিক মেশিনারির অভিযোগ করেন। যদিও সিট বা সুপ্রিম কোর্ট কোথাও তাঁর অভিযোগ ধোপে টেকে নি। তবে, আইপিএস সঞ্জীব ভাটের এই হলফনামার ফলে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং আরও অন্যান্য নেতারা সিট এর সামনে হাজির হতে বাধ্য হন।
আরও পড়ুন: রথযাত্রার আগেই ষাঁড়ের তাড়া খেলেন মুকুল রায়
সুপ্রিম কোর্টে তাঁর হলফনামায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের পুলিশ অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন–
“এক বিশেষ সম্প্রদায়ের উপরে আর এক সম্প্রদায়ের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দেওয়া হোক, বাধা দেবেন না”। যদিও, সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা নিযুক্ত বিশেষ তদন্ত কমিটি বা সিট তার সাক্ষ্যকে নাকচ করে দেয়, তার আরোপ খারিজ করে ক্লোজার লিস্ট জারি করে দেয়। যার ফলে নরেন্দ্র মোদী এবং রাজ্যের অন্যান্য নেতাদের ক্লিনচিট দিয়ে দেওয়া হয়।
আইপিএস সঞ্জীব ভাট নানাবতী কমিশন এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য গঠিত ন্যাশনাল কমিশন এর সামনেও নিজের হলফনামা পেশ করেন। যে অভিযোগে তিনি ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গায় সরকারের মূখ্য ভূমিকা এবং প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানান। যদিও আদালতে তিনিই ভুল প্রমাণিত হন, কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সোচ্চার হওয়া ভারতের একমাত্র পুলিশ আধিকারিক তিনিই।
আরও পড়ুন: দলকে লজ্জায় ফেলে ঘুষ কান্ডে জেলে বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী
কিন্তু দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তাঁর মতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য এনাকে এবং এনার পরিবারকে নিত্য ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়। অভিযোগ, একের পর এক মামলাতে মাকড়সার জালের মত জড়িয়ে ফেলা হয় তাঁকে। কর্তব্যের দিন থেকে অনধিকারে ছুটির অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়। হাস্যকর বিষয় হলো এটাই, যখন তিনি নানাবতী কমিশনের নির্দেশে তদন্ত কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন তখনই তাকে অনুপস্থিত দেখানো হয়!
আরও পড়ুন: ভারতে আরও বড় ‘প্রাণঘাতী’ ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা
সুপ্রিম কোর্ট তাঁর সব অভিযোগ খারিজ করে দেয়। ফলে ২৭ বছর ধরে পুলিশে কাজ করার পরেও কোন পেনশন, গ্রাচুইটি ছাড়াই তাঁকে সাংবিধানিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৯ শে আগস্ট তাঁকে আইপিএস থেকে বহিস্কার করা হয়। সরকারি নির্দেশে এই দুঁদে পুলিশ অফিসারের তৈরী বাড়িতে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগে, বুলডোজার দিয়ে বাথরুম এবং রান্নাঘর ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
তাঁকে গ্রেফতার করে অনেক মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। আজও, জামিনে থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে এখনও বিভিন্ন তদন্ত চলছে। তাঁর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি বিরোধী কংগ্রেসের হয়ে কাজ করতেন। কারণ, তাঁর স্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন।
কিন্তু অনেকেই জানেন না, ২০১১ তে গুজরাটের মৌলনা মহম্মদ আলী জওহর একাডেমি তাঁর সাহসিকতার জন্য তাঁকে পুরস্কার দেয়। কিন্তু তিনি সেই পুরস্কার নেন নি। কারণ, আর একজন ওই পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেস নেতা জগদীশ টাইটেলার। সঞ্জীব ভাট মনে করতেন, ১৯৮৪ র শিখ নিধন দাঙ্গায় কংগ্রেস নেতা জগদীশ টাইটেলার জড়িয়ে ছিলেন।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যা ও তারপরের গণহত্যার না জানা সত্যি
যদিও সরকারি তদন্ত ও সুপ্রিম কোর্টের রায় তাঁর বিরুদ্ধেই যায় তবু গোটা দেশে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দেন এই প্রাক্তণ আইপিএস। গুজরাটের আইপিএস রা বলেন, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এই একজন সৎ, সাহসী আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাটের দুঃখ-কষ্টের জীবন কাহিনীর মধ্যে নিহিত আছে। গুজরাটের আইপিএস অফিসারদের সংগঠন শেষ পর্যন্ত বিবেকের দংশনে এই বহিষ্কৃত অফিসারের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য হয়।
সমাজকর্মীরা বলেন, বাহাদুরির সঙ্গে ভ্রষ্টাচার, মিথ্যাচার, অত্যাচারী ব্যবস্থার সঙ্গে একাই ১৬ বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন তিনি। এটা ঠিক, সরকারি তদন্ত ও সুপ্রিম কোর্টের রায় দুটোই তাঁর বিরুদ্ধে যায় কিন্তু তাতেও এই আইপিএসের লড়াইকে ভারতের আইপিএস সংগঠন ও মানাবাধিকার সংগঠনগুলি সম্মান দিতে বাধ্য হয়।
মঙ্গলবার সেই ২০০২ সালের গুলমার্গ গনহত্যার অভিযোগ আবার শুনবে বলে নির্দেশ দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। জাকিয়া জাফরীর অভিযোগ তৎকালিন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরূদ্ধে। আর শীর্ষ আদালতের এই রায়ের পিছনে কোন উকিল নয়, বহিষ্কৃত আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাটের অবদানই সবচেয়ে বেশি আছে।