ইতিহাসে চেপে দেওয়া ঘটনা, পাঠান ও সুলতান রাজত্বের যম বাংলার ‘রায়বাঘিনী’। ইতিহাস বইয়ে আমাদের পড়ানো হয় না, আমরা জানতেও পারি না; এমন অনেক ইতিহাস এখন প্রকাশ্যে আসছে, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার এক বীর নারী; পাঠান ও সুলতান রাজত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। স্বয়ং মুঘল সম্রাট আকবর বাদশা; তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘রায়বাঘিনী’। কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে ও স্মৃতিতে; কোন ‘রায়বাঘিনী’ নামের বীরাঙ্গনা নেই।
ভারতে বা বাঙালির কাছে রানী ভবশঙ্করী নামটা; ততটা পরিচিত নয়। কিন্তু রানী ভবশঙ্করী অবিভক্ত বাংলার মুসলমান শাসকদের কাছে একটা আতঙ্ক ছিলেন; যাকে বাংলার সুলতানি শাসক, পাঠান শাসকরা কোনোদিন পরাজিত করতে পারেনি। এমনকি রানী ভবশঙ্করীর শাসনকালে; মুঘল সম্রাট আকবর ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন। তাঁর নতুন নাম হয় ‘রায়বাঘিনী’।
রানী ভবশঙ্করীর জন্মসূত্রে নাম ছিল ভবশঙ্করী চৌধুরী; তাঁর জন্ম হয়েছিল ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে। সেই সময় ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য; বর্তমান হুগলি ও হাওড়া জেলা জুড়ে ছিল। তাঁর পিতা দীননাথ চৌধুরী, রাজা রুদ্রনারায়ণের সাম্রাজ্যে একজন দুর্গরক্ষক ছিলেন; সেনাদের যুদ্ধবিদ্যার প্রশিক্ষণ দিতেন।
ছোটবেলা থেকেই ভবশঙ্করী; পিতার কাছে অস্ত্র শিক্ষা পান। ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা, তরোয়াল যুদ্ধ; তীর ছোঁড়া ইত্যাদির প্রশিক্ষণ নেন। মাঝে মাঝে পিতার সঙ্গে; যুদ্ধ অভিযান এবং শিকার অভিযানে যেতেন। এছাড়াও ভবশঙ্করী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতদের কাছ থেকে; সমাজশাস্ত্র, রাজনীতি, দর্শন, কূটনীতি এবং ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
ভবশঙ্করীর সঙ্গে রাজা রুদ্রনারায়ণ-এর বিবাহ হয়। একবার ভবশঙ্করী শিকারে গিয়েছিলেন; সেখানে একদল বুনো মহিষ ভবশঙ্করীকে আক্রমণ করে। কিন্তু ভবশঙ্করী তরোয়াল চালানোর অসাধারণ দক্ষতায়; সবকটি বুনো মহিষকে হত্যা করেন এবং শিকার অভিযানে থাকা বাকিদের রক্ষা করেন। রাজা রুদ্রনারায়ন দূর থেকে এটা লক্ষ্য করেন এবং এই যুদ্ধ দক্ষতায় মুগ্ধ হন। তিনিই ভবশঙ্করীর পিতাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন এবং খুব শীঘ্রই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। ব্রাহ্মণ কন্যা ভবশঙ্করী চৌধুরী; পরিচিত হন রানী ভবশঙ্করী নামে।
বিবাহের পরেই রানী ভবশঙ্করী রাজ্য শাসন বিষয়ে; রাজা রুদ্রনারায়নকে সাহায্য করতেন। মা চন্ডীর ভক্ত ছিলেন তিনি। বিয়ের পরেই রাজপ্রাসাদের পাশেই; দেবী চন্ডীর মন্দির নির্মাণ করান। রোজ নিষ্ঠাভরে মা চন্ডীর পূজা করতেন। আজও হাওড়া ও হুগলী জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যে বেতাই চন্ডী এবং মেলাই চন্ডীর পূজা হয়ে থাকে; তা ভবশঙ্করীর শাসনকালেই হিন্দুদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দেবী চন্ডীর অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করেন; তার অনেক মন্দির আজও বিরাজমান।
তিনি সাম্রাজ্যের সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেন। ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে; অনেকগুলো সামরিক দুর্গের নির্মাণ করেন। তিনি খানাকুল, ছাউনপুর, তমলুক, আমতা, উলুবেড়িয়া, নস্করডাঙ্গায় দুর্গ নির্মাণ করেন। সেই সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণের বিষয়টিও দেখভাল করতেন; তাঁর নজরদারিতে অনেকগুলি সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হত।
তিনিই প্রথম ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে মহিলাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিয়ে; সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সঙ্গে তিনি নিয়ম করেন যে, এই সাম্রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের একজনকে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে হবে; যাতে আপদকালীন পরিস্থিতিতে সেনার দরকার পড়লে যুদ্ধে যোগ দিতে পারে।
সেই সঙ্গে তিনি নৌবাহিনীর দিকেও নজর দেন। রানী ভবশঙ্করীর তত্ত্বাবধানে, ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের নিজস্ব নৌবাহিনী গঠন করেন; যা সেই সময়ে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সেই সময় গৌড়ের শাসক ছিলেন; পাঠান বংশীয় সুলেমান কারী। মুসলিম শাসকদের লুটেরা বাহিনী, ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে; অতর্কিত হামলা করে লুঠপাট চালাত। তাই এদের শায়েস্তা করতে রানী ভবশঙ্করীর পরামর্শে; উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের সঙ্গে জোট করেন রাজা রুদ্রনারায়ন।
১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেনির যুদ্ধে, ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য এবং মুকুন্দদেবের মিলিত সেনাবাহিনী; গৌড়ের সুলতান সুলেমান কারীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুকুন্দদেবের সেনাপতি রাজীবলোচন রায়; যিনি পরে কালাপাহাড় নামে বিখ্যাত হন।
সুলেমানের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র দাউদ খান; গৌড়ের শাসক হন। তিনি মুঘলদের পরাজিত করার জন্য; রাজা রুদ্রনারায়নের সাহায্য চান। রুদ্রনারায়ন রাজি না হলে, দাউদ খান তাঁর সেনাপতি কলটু খানকে; ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য আক্রমণের নির্দেশ দেন। রুদ্রনারায়নের সেনাবাহিনী কলটু খানের সেনাকে; শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ও তাকে হত্যা করে। এই যুদ্ধে বিশাল সংখ্যক পাঠান সেনার মৃত্যু হয়। এর ফলে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল; পাঠান শাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।
রানী ভবশঙ্করী এক পুত্র সন্তান প্রতাপনারায়নের জন্ম দেন। প্রতাপনারায়নের বয়স যখন ৫ বছর; তখন রাজা রুদ্রনারায়নের মৃত্যু হয়। ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজবংশের কুল পুরোহিত রানী ভবশঙ্করীকে; রাজ্যের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান। যতদিন না পর্যন্ত রাজকুমার প্রতাপনারায়ণ; প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠেন। রানী রাজ্যের শাসনভার সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন।
কিন্তু সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে; সুলতান ওসমান খানের সঙ্গে চক্রান্ত করেন। রানী ভবশঙ্করী এবং তাঁর নাবালক পুত্র প্রতাপনারায়ণকে; হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়। সেই মত চতুর্ভুজ সমস্ত তথ্য; ওসমান খানের কাছে পৌঁছে দেন। ওসমান খান তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে; রানীকে হত্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু ওসমান খানের সেনাবাহিনীকে কচুকাটা করে দেন; রানী ভবশঙ্করী। কৌশলে মন্দিরের মধ্যে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ হয়; ওসমান খান পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান।
চতুর্ভুজ চক্রবর্তীকে সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেন রানী; এবং ভূপতি কৃষ্ণ রায়কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এরপরেই পাঠান সেনাদের বিরুদ্ধে তাঁর বীরত্বের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা; বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় তাঁর যুদ্ধ করার কাহিনী; ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যের লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। রানী ভবশঙ্করী বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে ওসমান খানকে পরাজিত না করতেন; তাহলে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্য ও হুগলি-হাওড়া অঞ্চলে ইসলামের শাসন শুরু হত।
রানী ভবশঙ্করী তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হরিদেব ভট্টাচার্যের পরামর্শে; আশেপাশের বাগদি (বর্গ ক্ষত্রিয়) এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বাছাই করা যোদ্ধাদের, সেনায় সামিল করেন; যারা তীর ছোঁড়া এবং তরোয়াল চালানোয় বিশেষ দক্ষ ছিলেন। তাদের আগেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল; যেহেতু রানী ভবশঙ্করী রাজ্যের প্রত্যেক পরিবারের একজনের সেনা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছিলেন।
পাঠান সেনাপতি ওসমান খানের নেতৃত্বে পাঠান সেনাবাহিনী এবং বিশ্বাসঘাতক চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকা সেনাবাহিনী; ফের একযোগে রাণীকে আক্রমণ করে। রানী ভবশঙ্করী নিজে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এই যুদ্ধে রাজ্যের বাগদি ও চন্ডাল সেনারা; অসীম বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কয়েকঘন্টার যুদ্ধে পাঠান সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং পাঠান সেনাপতি ওসমান খান; ফের পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন।
রানী ভবশঙ্করীর বীরত্বের কথা, পাঠান সেনাদের ধূলিসাৎ করার কথা; মুঘল সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। আকবর ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলতে সক্রিয় হন; এর পিছনে অবশ্য কারণও ছিল। সেই সময় অবিভক্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা-যাকে সুবে বাংলা বলা হত; তার সুবেদার ছিলেন মান সিংহ। কিন্তু বাংলার বিভিন্ন অংশে; পাঠানদের অত্যাচার ছিল খুব। পাঠানরা মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলা ও লুটপাট চালাত। এ নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন আকবর; কারণ বাংলা সেসময় ছিল সোনার বাংলা।
কিন্তু রানী ভবশঙ্করী অসাধারণ রণকৌশল ও বীরত্বে; সেই পাঠান সৈন্যদের পরাজিত করেছিলেন। এইজন্য আকবর অন্য নীতি নিলেন। ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে সৌজন্য দেখিয়ে পাঠালেন; বাংলার সুবেদার মান সিংহকে। রাণী বুঝেছিলেন, একদিকে পাঠান ও অন্যদিকে মোঘল; দুইয়ের বিরুদ্ধে লড়া অসম্ভব ও অবাস্তব। শক্তিশালী মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়ার চেয়ে; আকবরের সঙ্গে সন্ধি করে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভমত্ব বজায় রাখা দরকার।
ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সঙ্গে দিল্লির চুক্তি সম্পূর্ন হল; আকবর ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মেনে নিলেন। রানী ভবশঙ্করীকে ‘রায়বাঘিনী’ উপাধিতে; ভূষিত করেন সম্রাট আকবর। এরপর অনেক বছর রানী ভবশঙ্করী; স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করেন। পরে তাঁর পুত্র প্রতাপনারায়ন প্রাপ্তবয়স্ক হলে; তাঁর হাতে রাজ্যের ভার দিয়ে; তিনি কাশীতে তীর্থে চলে যান।
আজও হাওড়া জেলার উদনারায়নপুরে; রানী ভবশঙ্করী প্রতিষ্ঠিত রায়বাঘিনী মন্দির রয়েছে। আজও গড় ভবানীপুর রয়েছে; আজও চণ্ডী পুজো রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় রানী ভবশঙ্করীর তৈরি করা চণ্ডী মন্দির রয়েছে। শুধু ইতিহাস বইয়ের পাতায় আর বাংলার মানুষের মনে; ‘রায়বাঘিনী’ রানী ভবশঙ্করী কোথাও নেই….।
Copyright: The News বাংলা