বিশেষ রিপোর্ট :‘গত ১৫ বছর ধরে সন্ত্রাস দমনের নামে আমেরিকার কাছে অর্থ নিয়ে ঠকিয়েছে পাকিস্তান’, বক্তার নাম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের হিসাব অনুযায়ী গত ১৫ বছরে ৩৩০০ কোটি ডলার পাকিস্তানকে দিয়েছে আমেরিকা৷ তাও আবার সেটা নাকি সন্ত্রাস দমনের জন্য৷ ভারতবাসীর কাছে এর চেয়ে হাসির তথ্য আর হতে পারে না৷ আর তাতেই প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র, এটাও কি আমেরিকার ফাঁকা বুলি৷
১৯৪৭ এ কাশ্মীরকে নিয়ে লড়াই বাদ দিলে ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ এ ভারত পাক যুদ্ধ দেখেছে গোটা বিশ্ব৷ ১৯৭১ সালে মুখোমুখি যুদ্ধে হারার পর ১৯৮০ র দশক থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে নেমেছে পাকিস্তান৷
১৯৮০ র পর আজ পর্যন্ত ৬ জন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে দেখেছে ভারত৷ এনারা হলেন, রোনাল্ড রেগন(১৯৮১-১৯৮৯), জর্জ বুশ (সিনিয়ার ১৯৮৯-১৯৯৩), উইলিয়াম ‘বিল’ ক্লিন্টন(১৯৯৩-২০০১), জর্জ বুশ (জুনিয়ার ২০০১-২০০৯), বারাক ওবামা (২০০৯-২০১৭) আর ২০১৭ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প৷
এঁরা প্রত্যেকেই পাকিস্তানকে কখনও না কখনও সন্ত্রাসবাস কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সাহায্য বন্ধ করে দেবার হূমকি দিয়েছেন৷ কিন্তু পাকিস্তান কোনদিন আমেরিকার সাহায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় নি৷ ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকারোক্তিই তার প্রমাণ৷ ১৫ বছরের ৩৩০০ কোটি ডলার আমেরিকা দিয়েছে পাকিস্তানকে৷
ফের মার্কিন প্রেসি়ডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দিলেন, ‘সন্ত্রাস দমনের নামে বছরের বছর অর্থ নিয়ে ঠকিয়েছে পাকিস্তান৷ জঙ্গি দমনের নামে ১৫ বছর ধরে পাকিস্তান আমাদের থেকে ৩৩০০ কোটি ডলার নিয়েছে৷ অথচ বিনিময়ে ঝুড়ি-ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলা ছাড়া কিছুই করেনি৷ প্রেসিডেন্টের এই ক্ষোভের পরই পাকিস্তানকে ২৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা আপাতত আটকে দিল আমেরিকা৷ হোয়াইট হাউস সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সে দেশে জঙ্গি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়, তার ওপরই নির্ভর করবে এই আর্থিক সাহায্যের ভবিষ্যত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন প্রশাসনের এক পদস্থ আধিকারিক সংবাদসংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, ২০১৬ আর্থিক বর্ষের বিদেশী সামরিক সহায়তা খাতে ২৫৫ মিলিয়ন ডলার এবার পাকিস্তানের জন্য ব্যয়ের কোনও পরিকল্পনা নেই। প্রেসিডেন্ট সাফ বলেছেন যে, পাকিস্তান তাদের দেশে সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করে আমেরিকা৷ পাকিস্তানের সহযোগিতার মাত্রা খতিয়ে দেখার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন৷
১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল জিয়া উল হককে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন, যে ভারত যেকোন মূহুর্তে পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার বোমা বানাবার পরিকল্পনার উপর মিলিটারি হামলা চালাতে পারে৷ ‘‘Talking Points for Use in Delivering Letter to General Zi’’, ১৯৮৪ সালের ১২ ই সেপ্টেম্বর লেখা একটি চিঠি ফাঁস হবার পরই এই ঘটনা সামনে আসে৷
অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট রেগনও পাকিস্তানের ভূমিকার কথা ও ভারতের প্রতিবাদের কথা জানতেন৷ প্রেসিডেন্ট রেগনের আমলেই CIA এর বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পাকিস্তানের লজ্জাজনক ভূমিকা বা দ্বিচারিতার কথা বারবার উঠে এসেছিল৷ কিন্তু তা সত্বেও পাকিস্তানকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিতে ছাড়ে নি আমেরিকা৷ যা পাকিস্তান পুরোপুরি ব্যবহার করে এসেছে ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে৷
২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমলে ৩ বিলিয়ান ডলার সামরিক সাহায্য পায় পাকিস্তান৷ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য৷ আর তারপরেই পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দেখে এই জর্জ বুশই বলেছিলেন, বোমা ফেলে পাকিস্তানকে শেষ করে আবার পাথরের যুগে ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ আর এই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছিলেন স্বয়ং পাক রাষ্ট্রপতি পারভেজ মুশারফ৷
২০০৮ এর মুম্বাই হামলার চক্রীদের কঠোর শাস্তি দিতে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ ২০১৫ তে পাকিস্তানকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন বারাক ওবামা৷ পাকিস্তানকে সমস্ত সন্ত্রাববাদী কার্যকলাপ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ জাতিসংঘকেও জানিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানকে বাধ্য করা হোক সন্ত্রাসবাদকে মদত না দেওয়ার জন্য৷ এমনকি ২০১৬ তে নিজের পাকিস্তান সফর বাতিল করে দেন ওবামা৷ কিন্তু তারপরেও পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত করে নি আমেরিকা৷
তাই ট্রাম্পের এই হূমকিকেও সেই একই ‘থোড় বড়ি খাড়া’ হিসাবেই দেখছেন ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা৷ তাঁরা মনে করছেন এর সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোন ভূমিকাই নেই৷ বিগত কয়েক বছরে চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক অনেকটাই বেড়েছে পাকিস্তানের৷ আর সেটাতেই বেজায় ক্ষুব্ধ আমেরিকা৷ আর তার জন্যই আপাততঃ পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ রাখল আমেরিকা৷
তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষেশজ্ঞ ইমনকল্যাণ লাহিড়ি মনে করছেন যে, এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা৷ যেভাবে এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি পাকিস্তানের নাম করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ও আমেরিকাকে ঠকানোর কথা বলেছেন তাতে এবার যে এটা আর ফাঁকা আওয়াজ নয়, তা আমেরিকার বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পরিস্কার বলে মনে করছেন তিনি৷ ইমনকল্যাণ লাহিড়ির মতে, সম্প্রতি ভারত যে সীমান্তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এতটা ‘আপারহ্যান্ড’ বা সদর্থক ভূমিকা নিতে পারছে তার পিছনেও দুই শক্তিধর দেশ আমেরিকা ও রাশিয়ার পরোক্ষ মদত আছে৷
তাই ট্রাম্পের এই ক্ষোভ ও আর্থিক সাহায়্য বন্ধের ঘোষণা কতদিন বজায় থাকে সেটাই এখন দেখার৷ তবে, সীমান্তে যেভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ছে ভারত, তাতে বলাই যায় বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে ভারতের দিকেই৷ সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এবার আর সহজে ছাড় পাবে না পাকিস্তান৷ তাই আমেরিকার এই কড়া পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে থাকবে ভারতও৷ শেষ ১৫ বছরের মত বড় ভুল আমেরিকা আর করবে না বলেই মনে করছে ভারত সরকার৷