The News বাংলা, মুম্বাই: একে ৪৭ এর সব গুলি বুক ফুঁড়ে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেলেও, তাঁর হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারে নি পাক জঙ্গী। তুকারাম ওম্বলের হাতই হয়ে উঠেছিল আজমল কাসভের ফাঁসির ফাঁন্দা।
আরও পড়ুনঃ ‘কাসভের বেটি’, জঙ্গি চিনিয়ে দেবার ‘পুরষ্কার’ পাচ্ছে দেবিকা
২৬,১১,২০০৮, ১০ বছর আগে সেদিন রাতের শিফটে ডিউটি ছিলো তুকারাম ওম্বলের। হালকা মেজাজে ভাবছিলেন কদিন পরেই শীতের আমেজ আসবে, মুম্বাই সেজে উঠবে উৎসবের মেজাজে। বান্দ্রা, জুহু, অন্ধেরি, সব জায়গা উঠবে ঝলমলিয়ে। ছেলে মেয়েরা ধরেছে শীতের ছুটিতে কোথাও একটা যাবে।

হাসি পেলো তুকারামের, পুলিশের আবার ছুটি। কোনো উৎসবেই তাদের ছুটি চাওয়া পাপ। গণপতি উৎসব, দেওয়ালি, হোলি কিছুতেই মেলে না ছুটি। তবু পরিবারের মানুষেরা চায় তাকে। এবার একটা চেষ্টা করবে ছুটি নেবার।
আরও পড়ুনঃ আন্দামান নর্থ সেন্টিনেলে ‘জাড়োয়া’দের তীরের মুখে ভারতীয় কমান্ড্যান্ট
ভাবতে ভাবতে মনটা পিছন ফিরে চলে গেলো। সেই কবে আর্মিতে যোগ দেবার পর থেকেই ছুটি বলে কিছু নেই জীবনে। তারপর কতদিন পেরিয়ে গেছে, খালি ডিউটি আর এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানো। বাড়ি থেকে কতো দূরে থাকতে হতো সেই সৈনিক জীবনে। কিন্তু সেই জীবনে একটা রোমাঞ্চ ছিলো। দেশরক্ষার গর্ব গর্বিত করতো। ঝুঁকি নিতে বেশ লাগতো।

দেশপ্রেমটা তার মধ্যে চিরকালই বেশি। আর্মি থেকে অবসরের পর যোগ দেন মুম্বাই পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর পদে। ঘর থেকে ডিউটি। নিরুপদ্রব জীবন, এতেই অভ্যস্ত হয়েছেন এখন। তাও মাঝে মাঝে আর্মির সেই দিনগুলো মনে পড়লে রক্ত গরম হয়, জীবন চায় আবার অভিযান করতে। আবার তারপর মনে হয় এই বেশ, পরিবারকে সময় দেওয়া যাচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ ‘শব্দের জন্য’ ট্র্যাজিক জীবন ভারতীয় সিনেমার জনকের
ভাবনার ছেদ পড়ল ইনস্পেক্টর ইন চার্জের উত্তেজিত কন্ঠে। ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস এ জঙ্গী হানা হয়েছে। বহু মানুষ হতাহত। জঙ্গীরা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে অ্যান্টি টেররিস্ট শাখার অফিসার হেমন্ত কারকারে, এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট বিজয় সালাসকারকে।

তাদের কোয়ালিস গাড়ি নিয়ে জঙ্গীরা এদিকেই আসছে। অফিসার দ্রুত পজিশন নিতে বললেন সবাইকে। রক্ত গরম হয়ে উঠলো ওম্বলের। ফোর্সকে রেডি হতে বলে লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়।
আরও পড়ুনঃ মোদী না রাহুল, মধ্যপ্রদেশ ও মিজোরামে জোর লড়াই
এদিকে ইসলামিক ফিদায়ে জঙ্গী গোষ্ঠীর দুই সদস্য আজমল কাসভ ও ইসমাইল খান শিবাজি টার্মিনাস এ হামলা চালিয়ে প্রচুর মানুষকে হত্যা করে বাইরে বেরিয়ে এলো। চারদিকে আতঙ্কিত মানুষের ছোটাছুটি, চিৎকার। ততক্ষণে হাই অ্যালার্ট জারি করেছে পুলিশ। হঠাৎ জঙ্গিদের গাড়ির চাকা বার্স্ট করলো। তারা একটা অন্য গাড়ি দখল করে ছুটলো। মুম্বাই পুলিশের অসহায় আত্মসমর্পণ আর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এর বহর দেখে মজা করতে লাগল তারা।

বেশ মজা লাগলো পাক জঙ্গীদের। ভারতীয়গুলোর রক্ত দেখা পবিত্র কর্তব্য। আবার কয়েক রাউন্ড গুলি করলো জনগনকে লক্ষ্য করে। চিৎকার আরো বাড়লো। দেখা গেলো একটা টয়োটা গাড়ি আসছে লাল বাতি লাগানো। পজিশন নিলো তারা। গাড়ি থেকে সালাস্কার, হেমন্ত কারকারে প্রমুখ নামতেই গুলিবর্ষণ শুরু করলো। ঝাঁঝরা হয়ে গেলো অফিসাররা। গাড়িটার দখল নিলো কাসভ। গাড়ি ছুটলো তাজ হোটেল লক্ষ্য করে।
আরও পড়ুনঃ রামমন্দির নয়, হিন্দু ক্ষোভ থামাতে অযোধ্যায় রামমূর্তির ঘোষণা যোগীর
বাহিনী নিয়ে রাস্তায় নাকা চেকিং করছে পুলিশ। সমস্ত গাড়িতে তল্লাশি চলছে। চৌপট্টি এলাকায় ডবল ব্যারিকেড করেছে পুলিশ। দেখা গেলো তীর বেগে ছুটে আসছে একটি স্কোডা গাড়ি। আটকাতেই গাড়ি থেকে ছুটে এলো গুলির ঝাঁক। পুলিশও গুলি চালালো। এক জঙ্গী ঝাঁঝরা হয়ে গেলো।
আরও পড়ুনঃ ‘তাজমহল’ গড়া শেষ না করেই মারা গেলেন ‘শাহজাহান’
অপরজনের কাঁধে গুলি লাগলো। সে চালাচ্ছিল গাড়ি। দ্রুত ইউ টার্ন নিলো গাড়ি। ঝাঁপিয়ে পড়লেন তুকারাম। একে জ্যান্ত ধরবো। শরীরে ফুটছে আর্মি রক্ত। দেশপ্রেমের আদর্শ উত্তাল সমুদ্রের মতো উথাল পাথাল করছে। কানে বাজছে সেই মিলিটারি কমান্ডারের আদেশ, “দেশকি শত্রুও কো হাম নেহি ছোড়েঙ্গে। দেশ হামারে মা হ্যায়। মিট্টিমে মিলা দুঙ্গা দেশ কি শত্রুও কো।”

তুকারাম হাতের লাঠি দিয়ে সজোরে ঘা দিলেন গাড়ির দরজায়। এক হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললেন গেট। টেনে ধরলেন তার বন্দুকের নল। ঝাঁপিয়ে পড়লেন জঙ্গীর ওপর। জঙ্গী গুলি শুরু করলো। বুকে পরপর ঢুকে যাচ্ছে বুলেট। রক্তে ভিজছে তার ইউনিফর্ম। বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে ছুটছে রক্তের ফোয়ারা।
আরও পড়ুনঃ ধর্মান্তরকরণের উদ্দেশ্যে এসে আদিবাসীদের হাতে নিহত মার্কিন খ্রীষ্টান মিশনারী
কিন্তু লৌহকঠিন দুই হাত পেঁচিয়ে ফেলেছে জঙ্গীর গলা। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছেন তাকে। যেভাবে ধৃতরাষ্ট্র কঠিন হাতে পিষে দিয়েছিলো লৌহ ভীমকে। সেভাবেই আঁকড়ে ধরলেন কাসভকে। অক্টোপাসের নাগপাশ ছাড়াতে পারল না সে।

অন্য পুলিশরা ধরে ফেলল কাসভকে। বন্ধন আলগা হোল তুকারামের। দু হাত প্রসারিত করে শুয়ে পড়লেন দেশের মাটির ওপর। ভলকে ভলকে রক্ত ভাসিয়ে দিলো তার জামা। আকাঙ্ক্ষিত ছুটি মিলল তাঁর। তবে চিরদিনের মত। রাতটা ছিল ২৬/১১ সালটা ২০০৮। শহীদ হলেন তুকারাম ওম্বলে।
আরও পড়ুনঃ সব প্রশ্নের জবাব দিতে আসছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জীবনী
তাঁর অসম সাহসী এই লড়াই সেদিন ধরিয়ে দিয়েছিলো মুম্বই হামলার একমাত্র জীবিত জঙ্গী কাসভকে। তার থেকে জানা গিয়েছিলো তার পাকিস্তানি পরিচয়। আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের মুখোস খুলে দেবার অকাট্য প্রমান পেয়েছিল ভারত।
সরকার সম্মান জানিয়েছিল এই বীর শহীদকে। প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁকে মরণোত্তর অশোক চক্র সম্মান দেওয়া হয়েছিলো। তিনি প্রমান করেছিলেন দেশদ্রোহীদের থেকে দেশপ্রেমিকদের ক্ষমতা অনেক বেশী। সম্মান জানাই তাঁকে। জয়হিন্দ। জয় তুকারাম ওম্বলে।