The News বাংলা, মুম্বাই: ‘রাজা হরিশচন্দ্র’র নির্মাতা ভারতীয় ‘চলচ্চিত্রের জনকের’ নিজের জীবনও ওই পৌরাণিক চরিত্রের মতোই ট্র্যাজিক। তিনি আর কেউ নন, দাদাসাহেব ফালকে।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁরই হাতে। প্রথম ছবি ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ বানিয়ে নিজের অজান্তেই স্থাপন করেছিলেন মাইলফলক। অংশীদার হয়েছিলেন ইতিহাসের। কাকতালীয় হলেও, ট্র্যাজিক পৌরাণিক চরিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’র সঙ্গে তাঁর নিজের জীবনেরও আশ্চর্য মিল। তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক দাদাসাহেব ফালকে।
মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে ৩০ কিমি দূরে পুণ্যভূমি ত্র্যম্বকেশ্বর। সেই তীর্থস্থানেই দাদাসাহেব ফালকের জন্ম ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল। এক মরাঠি ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন নামী পণ্ডিত। পিতৃদত্ত নাম ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে।
আরও পড়ুনঃ বলিউডে নতুন যুগের তারকারা কত পারিশ্রমিক পান
জে.জে স্কুল থেকে পাশ করে পড়াশোনা বরোদায় মহারাজ সয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাশাপাশি তাঁর পড়াশোনার বিষয় ছিল ফটোগ্রাফি বা চিত্রগ্রহণও।
ফোটোগ্রাফিই ছিল জীবনের প্রথম পেশা। ছবি তোলার ছোট্ট দোকান শুরু করেছিলেন গোধরায়। কিন্তু বন্ধ করে দিতে হল সে ব্যবসা। প্লেগের আক্রমণে একসঙ্গে মারা গেলেন প্রথম স্ত্রী এবং শিশুকন্যা।
এরপর কয়েক বছর বিচ্ছিন্ন ভাবে কেটেছে দিশাহীন জীবন। কখনও এএসআই -এর ড্রাফ্টসম্যান, কোনও সময় প্রিন্টিং, লিথোগ্রাফির কাজ। বিখ্যাত শিল্পী রবি বর্মার সঙ্গে কাজ, চলছিল খাপছাড়া ভাবে। ইতিমধ্যে পরিচয় লুমিয়ের ব্রাদার্সের কার্ল হার্টজ-এর সঙ্গে। এরপর, প্রিন্টিং প্রেস শুরু করলেন নিজের। তারপর, কাজ শিখতে পাড়ি দিলেন জার্মানি।
আরও পড়ুনঃ বউয়ের জন্য সিঁদুর পরে হিন্দু প্রথা ভাঙলেন রণবীর সিং
দেশে ফিরে অংশীদারের সঙ্গে ঝামেলার জেরে ছেড়ে দিলেন ব্যবসা। মন দিলেন ছবি তৈরিতে। বিশেষ অনুপ্রাণিত হলেন নির্বাক ছবি ‘দ্য লাইফ অফ ক্রাইস্ট’ দেখে। ১৯১২ সালে বানালেন ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। প্রথমবার প্রদর্শিত হল পরের বছর তত্কালীন বম্বের করোনেশন সিনেমায়-য়, পরের বছর মে মাসে।
তৈরি হল ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে নতুন মাইলস্টোন। ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ হল প্রথম নির্বাক মরাঠি ছবি। সেটা আবার প্রথম নির্বাক ভারতীয় ছবি। তথা প্রথম ভারতীয় ছবি।
তাঁর পুরো পরিবার অংশ নেয় ‘রাজা হরিশচন্দ্র’র নির্মাণে। দ্বিতীয় স্ত্রী সামলেছিলেন কুশীলবদের পোশাক। যাকে বলে ড্রেস ডিজাইনিং। তাঁর শিশুপুত্র অভিনয় করেছিল ‘রাজা হরিশচন্দ্র’র ছেলের ভূমিকায়।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মূলত পৌরাণিক বিষয়বস্তুই উঠে আসতে থাকে তাঁর ছবিতে। মোহিনী ভস্মাসুর, সত্যবান সাবিত্রী, লঙ্কাদহন, শ্রীকৃষ্ণ জন্ম, কালীয় মর্দন, বুদ্ধদেব, সেতুবন্ধন, গঙ্গাবতরণ, একের পর এক সফল ছবি বানান তিনি। প্রথম ছবি বানাতে যে অর্থ সঙ্কট হয়েছিল, তাও দূর হয়। এগিয়ে আসতে থাকেন পৃষ্ঠপোষকরা।
আরও পড়ুনঃ বলিউডের যে নায়িকাদের জীবনসঙ্গী ডিভোর্সি পুরুষ
দীর্ঘ উনিশ বছরের কেরিয়ারে ৯০টা ছবি এবং ২৬টা শর্ট ফিল্ম বানিয়েছেন। তাঁর পরিচালনায় শেষ নির্বাক ছবি ‘সেতুবন্ধন’ মুক্তি পায় ১৯৩২ সালে। পরে মুক্তি পায় ডাবিং-সহ।
তাঁর জয়যাত্রা থমকে যায় ছবিতে শব্দ সংযোজনে। সিনেমায় শব্দ আসার পর, শেষ হয়ে যায় তাঁর সব ম্যাজিক। অস্তমিত হয় সাফল্য। শব্দই শেষ করে দেয় তাঁর কার্যকারিতাকে। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। তাঁর প্রযোজনায় শেষ ছবি ‘গঙ্গাবতরণ’ মুক্তি পায় ১৯৩৬ সাল নাগাদ।
আরও পড়ুনঃ ‘বাঘের সঙ্গে অভিনয় করাটাই ছিল জীবনের সেরা চ্যালেঞ্জ’
ছবি জগত্ থেকে নিজেকে উপড়ে নিয়ে অবসরে চলে যান এরপর। শুরু হয় ঠিক যেন ‘রাজা হরিশচন্দ্র’র জীবন। প্রায় বনবাসে। জীবনের সমস্ত আলো থেকে একা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক প্রয়াত হন নাসিকে ১৯৪৪-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি।
তাঁর নামে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার তো আছেই। পাশাপাশি ১৯৭১ সালে ডাকটিকিট প্রকাশ করে ভারতীয় ডাক বিভাগ। শেষ জীবনে তাঁর তৈরি ‘রাজা হরিশচন্দ্র’র মতই অবস্থা হয় তাঁর। তবে, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে চিরদিন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে দাদাসাহেব ফালকের নাম।