‘বর্বর পাকিস্তান’, সাড়া শরীরে প্রমাণ নিয়ে ২৩ বছর আগে আজকের দিনেই; দেশে ফিরেছিলেন কার্গিল যুদ্ধের প্রথম শহিদ ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া ও তাঁর দল। হিমাচলের পালামপুরের ডিএভি স্কুলে পড়ত, মিষ্টি চেহারার লাজুক এক ছেলে; কথা বলত খুব কম। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী; অমৃতসর থেকে পড়তে এসেছে সে; ক্লাসে বরাবরই প্রথম। অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে গেল; স্নাতক স্তরেও দুর্দান্ত ফল করল। বন্ধুরা ভেবেছিল, হয় সে বিজ্ঞানী হবে; নয় প্রফেসর। না, সে সব কিছুই হননি সে।
১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে কম্বাইন্ড ডিফেন্স সার্ভিস পরীক্ষায় বসে সফল যুবক; যোগ দিলেন ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে। এর পর ১২ ডিসেম্বর, ১৯৯৮, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জাঠ রেজিমেন্টের ফোর্থ ব্যাটেলিয়নে; ক্যাপ্টেন হয়ে যোগ দিলেন সৌরভ কালিয়া। প্রথম পোস্টিংই হল কার্গিলের কাকসার সেক্টরে। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে; কার্গিলে ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে যোগ দিলেন সৌরভ।
১৯৯৯ সালের মে মাস; পাহাড়ে পাহাড়ে শীতে পড়া বরফ গলতে শুরু করেছে। শীতকালে প্রচুর বরফ পড়ে কাকসার সেক্টরে; তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের অনেক নীচে। ন্যাড়া পাহাড় চূড়ায় থাকা, ভারতীয় ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্কারগুলো চলে যায় বরফের তলায়। লিখিত চুক্তি অনুযায়ী, ভারতীয় ও পাক সেনারা তখন; বাঙ্কার ছেড়ে নেমে আসেন তাঁদের শীতকালীন পজিশনে। গ্রীষ্মকালে পাহাড় চূড়ার বরফ গলে গেলে আবার তাঁরা উঠে যান পাহাড়চূড়ার বাঙ্কারে; তাঁদের গ্রীষ্মকালীন অবস্থানে।
৯৯ এ চুক্তি ভেঙে; বিশ্বাসঘাতকতা করল পাকিস্তান। শীতেও তারা নামল না তাদের পজিশন ছেড়ে; উল্টে সেনার সঙ্গে জ’ঙ্গি দল পাঠিয়ে দখল করে নিল ভারতের পজিশন-গুলো। ১৯৯৯-এর ১৫ মে সৌরভ ছিলেন; ১৪ হাজার ফিট উঁচুতে বজরঙ্গ পোস্টে। কাকসার লাংপা এরিয়ায়; ভারতীয় সেনার জোরদার পেট্রল চলছে। জানার চেষ্টা হচ্ছে, কতখানি বরফ গলেছে; কবে ফেরা যাবে শীতে ছেড়ে আসা গ্রীষ্মকালীন অবস্থান-গুলিতে।
১৮০০০ ফুট ওপরে, লাইন অফ কন্ট্রোলের কাছে থাকা, একটি ভারতীয় পজিশনের বর্তমান অবস্থা দেখতে; একটি ছজনের দল পাঠায় ভারতের ১২১ নং ব্রিগেড। দলে ছিলেন ২২ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া ও পাঁচ জওয়ান। তাঁরা হলেন, সিপাই ভিখা রাম‚ অর্জুন রাম‚ ভনওয়র লাল বাগারিয়া‚ মূলা রাম ও নরেশ সিং।
হঠাৎ, সৌরভ কালিয়ার নজরে পড়ল; একটা ভারতীয় বাঙ্কারে কিছু মানুষের নড়াচড়া। অবাক হয়ে যায় দলটি। ভারতীয় সেনা তো গ্রীষ্মকালীন পজিশনে যায় নি; ওরা তাহলে কারা? তখনই পাকিস্তানি রেঞ্জার্সদের চিনে ফেললেন সৌরভ কালিয়া; সঙ্গে সঙ্গে ওয়াকিটকি-তে খবর পাঠালেন উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। জানালেন, শত্রুসেনা ঢুকে পড়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডে।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন শৃঙ্গ দখল করে বসা, পাকিস্তানি ফৌজের বাইনোকুলারেও ধরা পড়েছিল; সৌরভ কালিয়া আর পাঁচ জওয়ানের অবস্থান। সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুটে এল পাকিস্তানি সেনাদের দিক থেকে। বীরবিক্রমে সৌরভ কালিয়া ও তাঁর পাঁচ সঙ্গী গুলি করতে করতে; এগিয়ে চলেলেন নির্দিষ্ট পর্বতটির দিকে। তাঁরা তখন জানতেনও না; অভিমন্যুর মতই তাঁরা ঢুকে পড়ছেন এক চক্রব্যূহে। পাক সেনা ও উগ্রপন্থীদের পাতা ফাঁদে।
তাঁরা বুঝতেই পারেননি, শুধু সামনে নয়; আসে পাশে এমনকী পিছনের পাহাড়গুলির ওপরেও; ঘাপটি মেরে আছে অগণিত পাক সেনা। কিছুদূর এগোবার পর চারদিক থেকে গুলি আসতে থেকে; পাথরের আড়াল থেকে গুলি চালান ছজন বীর সেনানী। সাহায্য আসার আগেই শেষ হয়ে গেল গুলি, ঘিরে ফেলল পাক সেনা; আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন ছ’জন। কাকসার সেক্টরে, টহল দেওয়ার সময় নিখোঁজ হয়ে গেলেন; ক্যাপ্টেন সৌরভ সহ ছয় ভারতীয় সেনা।
আরও পড়ুন; আওতায় সব প্রতিবেশী দেশ, অগ্নি-৪ এর সফল পরীক্ষা করল ভারত
কিছুক্ষণ পরে ভারতীয় সেনার ব্যাক-আপ দল; সৌরভের জানানো জায়গাটিতে এসে সৌরভদের দলটিকে খুঁজে পায়নি। রক্ত, ধস্তাধস্তি বা অন্য কোনও চিহ্ন নেই মাটিতে কিংবা পাথরে। ভারতীয় সেনা এগোতে যেতেই; পাহাড়গুলির মাথা থেকে ছুটে আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি; প্রাণ হারালেন দুই ভারতীয় জওয়ান। ভারতীয় সেনা বুঝতে পারল; রীতিমত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে পাকিস্তান। নিয়ে এসেছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে; লাইন অফ কন্ট্রোল পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছে সাপ্লাই লাইন।
কিন্তু কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া আর তাঁর পাঁচ সঙ্গী? আসলে তখন তাদের উপর শুরু হয়েছে; পৈশাচিক অত্যাচার। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গোপন ক্যাম্পে; ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া ও তাঁর পাঁচ সঙ্গীর ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে পাক বাহিনী। ১৫ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত চলে; এই অমানুষিক অত্যাচার। জেনেভা কনভেনশনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে।
প্রথমে সৌরভ কালিয়া ও তাঁর সঙ্গীদের গায়ে; সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছিল। গরম শলাকা ঢুকিয়ে দুই কানের পর্দা ফুটো করে দেওয়া হয়েছিল। তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে চোখ গেলে দেওয়া হয়েছিল। মেরে মেরে সব দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। মাথার খুলি ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঠোঁট ও চোখের পাতা কেটে নেওয়া হয়েছিল। হাত ও পায়ের আঙ্গুল কেটে নেওয়া হয়েছিল। কেটে নেওয়া হয়েছিল যৌনাঙ্গও। তখনও বেঁচে ছিলেন তাঁরা। সব শেষে মাথায় গুলি করে; মেরে ফেলা হয়েছিল সৌরভ কালিয়া ও পাঁচ জওয়ানকে।
৯ জুন‚১৯৯৯, পাকিস্তান ফেরত দিল যুদ্ধবন্দি ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া সহ ছয় ভারতীয় সেনার দেহ। কফিন খুলে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ভারত; ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল ভারতবাসিরা। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানা গিয়েছিল; মৃত্যুর আগে ২২ বছরের সৌরভ কালিয়া ও তার সঙ্গী জওয়ানদের কী পৈশাচিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। সারা ভারতে ঝড় উঠল, ছয় জওয়ানের পৈশাচিক হত্যার খবর শুনে ভারতীয় বাহিনী তুমুল আক্রমণ করল পাকিস্তানি সেনাকে। জুলাইয়ে শেষ হয় অপারেশন বিজয়; ভারতের কাছে ফের একবার হার মানে পাকিস্তান সেনা।
হিমাচলের পালামপুরের পাহাড়ে, ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার বাড়ি ‘সৌরভ নিকেতন‘-এ; আজও আছে ‘সৌরভ স্মৃতি কক্ষ’। সেই মিউজিয়ামে আছে সৌরভ কালিয়ার ছবি‚ ইউনিফর্ম আর জুতো। ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার স্মৃতিতে, পালামপুরে ৩৫ একর জায়গায় জুড়ে; হিমাচল সরকার তৈরি করেছিল ‘সৌরভ বন বিহার’। তাঁর নামে আছে রাস্তা; ‘ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া মার্গ’। তাঁর বাড়ির মহল্লার নাম হয়েছে ‘সৌরভ নগর’; পাঞ্জাবের অমৃতসরে আছে; ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার মূর্তিও।
শাস্তি পেয়েছে পাকিস্তান; গোহারা হেরে মুখ লুকোতে হয়েছে আরও একবার। ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া সহ ছয় সেনার নৃশংস খুনিরা; আর পাকিস্তানে ফিরতে পারেনি। ভারতের হাতে কচুকাটা হবার পরে; কারোর মৃত শরীর নিয়েই যায়নি পাকিস্তান। অন্যদিকে, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়; শেষকৃত্য হয় ক্যাপেন সৌরভ কালিয়া ও তাঁর সঙ্গীদের; ভারতবর্ষ যাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে; কার্গিল যুদ্ধের প্রথম শহিদ হিসাবে।