‘কম্যান্ডো’৷ একটা শব্দই ঝাঁকিয়ে দেয় সাধারণ মানুষকেও৷ যে কোন সাধারণ সেনাবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালি, অনেক বেশি ক্ষিপ্র, চোখের পলক ফেলার আগেই শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পরতে সদা প্রস্তুত ভারতের এই কম্যান্ডোরা। বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় ভারতের ৯টি কম্যান্ডো বাহিনী যেন অধিক হিংস্র, ক্ষিপ্র ও গতিসম্পন্ন।
প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় এরা খুব বেশি পারদর্শী। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শত্রুর সামনে সাক্ষাৎ যম হয়ে উদয় হয়ে শত্রু বিনাশ করতে এদের জুড়ি মেলা ভার। বিপদ মোকাবিলায় এরা এতটাই ভয়ানক যে এই ৯ বাহিনীকে বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর কম্যান্ডো বাহিনী হিসাবে গণ্য করা হয়।
পড়ুন প্রথম পর্বঃ শত্রুকে নিমেষে নিকেশ করে ভারতের সেরা ৯ কম্যান্ডো বাহিনী
পড়ুন দ্বিতীয় পর্বঃ শত্রুকে নিমেষে নিকেশ করে ভারতের সেরা ৯ কম্যান্ডো বাহিনী
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, ভারতের এই ৯ কম্যান্ডো বাহিনীকে। তৃতীয় ও শেষ পর্বে আরও ৩ কম্যান্ডো বাহিনী সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিন।
৭. প্যারা কম্যান্ডোঃ ১৯৬৬ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এই কম্যান্ডো ইউনিটটি তৈরি করা হয়েছিল। এই কম্যান্ডো বাহিনী হল ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাশুট ডিভিশন। এদের কাজ হলো আকাশ থেকে ঝাঁপ দিয়ে শত্রুপক্ষের উপরে হামলা করে পদাতিক বাহিনীর অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
রোজ ৬০ কেজি ওজনের জিনিসপত্র পিঠে চাপিয়ে অন্তত ২০ কিলোমিটার দৌড়তে হয় এই কম্যান্ডো বাহিনীর সদস্যদের। সাড়ে তেত্রিশ হাজার ফুট উপর থেকে ঝাঁপ দিতে সক্ষম এরা। আকাশপথে শত্রুর এলাকায় অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে সমুদ্রপথে হামলায় দক্ষ এই বাহিনী। প্যারা কম্যান্ডোরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর একমাত্র ইউনিট, যাদের শরীরে ট্যাটু আঁকার অনুমতি দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
১৯৬৫ সালে ভারত পাক যুদ্ধের সময় একটা কম্যান্ডো ইউনিট গড়া হয়৷ নাম দেওয়া হয় মেঘদূত ফোর্স। মেজর মেঘ সিং এর নেতৃত্বে এই কম্যান্ডো বাহিনী কাজ করেছিল। এই বাহিনী দারুণ কাজ করেছিল ভারত পাক যুদ্ধে। তারপরেই পাকাপাকি ভাবে পদাতিক বাহিনীর একটা কম্যান্ডো ফোর্স গড়ার প্রয়োজনীয়তা লক্ষ করা হয়। তারপরেই তৈরী হয় প্যারা কম্যান্ডো বাহিনী। বিমান বা হেলিকপ্টারে প্যারা কম্যান্ডোদের নামিয়ে দেওয়া হয় ঘটনাস্থলে। শত্রু বা জঙ্গীদের উপর নিমেষে প্রথম হামলাটা করে এই কম্যান্ডোরা।
১৯৭১ সালের ভারত পাক যুদ্ধে প্রথমবারের জন্য প্যারা কম্যান্ডোদের দেখা যায়। ৬ সদস্যের প্যারা কম্যান্ডো ২৪০ কিলোমিটার ভেতরে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারা অতর্কিতে হামলা চালায় পাক আর্মির উপর। একটা ছোট্ট কম্যান্ডো বাহিনী ৪৭৩ জন পাকিস্থানী সৈন্যকে মেরে ফেলে, ১৪০ জনকে আহত করে।
পাকিস্থানের স্পেশ্যাল সার্ভিস গ্রুপের ১৮ জন সদস্যকে আটক করে ফেলে এই কম্যান্ডো দলের সদস্যরা। ১৯৮৪ সালের অপারেশন ব্লু স্টারে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরেও জঙ্গীদের হঠাতে অতর্কিতে আক্রমণে নামে প্যারা কম্যান্ডোরা। দেশে বিদেশে বিভিন্ন অপারেশনে সফল ভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে প্যারা কম্যান্ডো।
৮. কোবরা কম্যান্ডোঃ Commando Battalion for Resolute Action বা COBRA কম্যান্ডো। Central Reserve Police Force বা CRPF বাহিনীর এই কম্যান্ডো ফোর্সের সৃষ্টি হয়েছিল প্রধানত নকশাল ও মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে। ‘হয় মরো না হয় মারো’, এটাই কোবরা কম্যান্ডো বাহিনীর মূলমন্ত্র। জঙ্গলের মধ্যে যে কোনো ধরনের গেরিলা যুদ্ধে সক্ষম এই বাহিনী।
২০০৮ সালে মূলত নকশাল ও মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। কোবরা কম্যান্ডোরা এতটাই দক্ষ যে, মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গলে শত্রুর চোখে ধুলো দিতে পারে। তারা এমন পোশাক এবং মুখে রঙ মেখে অভিযানে নামে যে, চট করে জঙ্গলে তাদের দেখে ফেলা কঠিন। প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দিয়েও অভিযানে সক্ষম কোবরা কম্যান্ডোরা।
কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর অধীনে আসে কোবরা কম্যান্ডো বাহিনী। অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় ইনসাস রাইফেল থেকে একে ৪৭, এক্স ৯৫-এর মতো আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত কম্যান্ডোরা। কোবরা কম্যান্ডোদের নিশানা এতটাই নিখুঁত যে, যে কোনও স্থান থেকে শত্রুকে গুলি করে খতম করা এদের কাছে জলভাত। যে কোন অস্ত্র চালানোর পাশাপাশি যে কোন বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার ট্রেণিং দেওয়া হয় কোবরা কম্যান্ডোদের।
৯. ফোর্স ওয়ান কম্যান্ডোঃ ২৬/১১ মুম্বাই হামলার পর এই কম্যান্ডো বাহিনী তৈরি করেছে মহারাষ্ট্র সরকার। মুম্বাই পুলিশের এই কম্যান্ডো বাহিনীর মূল কাজ মুম্বইকে রক্ষা করা। বাণিজ্য নগরীর বুকে যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস প্রতিরোধে এই বাহিনীকে তৈরি করা হয়েছে। ফোর্স ওয়ান-এর কম্যান্ডোদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে যে মাত্র ১৫ মিনিটে এরা শত্রুপক্ষের ওপরে হামলা চালাতে সক্ষম।
২০০৮ এর মুম্বাই সন্ত্রাসের পরই ঠিক হয় মুম্বাই পুলিশের নিজস্ব কম্যান্ডো বাহিনী গড়ে তোলা হবে। ২৬/১১ এ মুম্বাই অ্যাটাক থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই কম্যান্ডো বাহিনী। ২০১০ এ তৈরী হয় মুম্বাই পুলিশের ফোর্স ওয়ান কম্যান্ডো। এই মূহুর্তে ফোর্স ওয়ানে ৩০০ জন কম্যান্ডো আছে। মুম্বাই পুলিশ বাহিনীর সেরা অফিসারদের ট্রেণিং দিয়ে কম্যান্ডো তৈরী করা হয়।
একবার ফোর্স ওয়ান কম্যান্ডো বাহিনীতে যোগদানের জন্য ৩০০০ আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ২১৬ জনকে বেছে নেওয়া হয়। ঠিক NSG বা ন্যাশান্যাল সিকিউরিটি গার্ডের মতই গড়ে তোলা হয়েছে ফোর্স ওয়ানকে। ইসরায়েলি স্পেশাল ফোর্সের অফিসাররা ট্রেণিং দেয় ফোর্স ওয়ান কম্যান্ডোদের। মুম্বাই অ্যাটাকের মত কোন হামলা হলে প্রথমেই ফোর্স ওয়ানের কম্যান্ডোরাই ঝাঁপিয়ে পরবে।
যে কোন বিপদের মোকাবিলায় সক্ষম ভারতের এই ৯ কম্যান্ডো বাহিনী। অসম্ভবকে সম্ভব করাই এদের কাজ। অবাস্তবকে বাস্তব করা এদের বাঁ হাতের খেল। ভারতের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় কম্যান্ডোরাও আছেন দেশের ও দশের নিরাপত্তায়। চোখের নিমেষে শত্রুনিধন করে এঁরা দেশ ও দেশবাসীকে নিশ্চিত রক্ষা করবেন যে কোন বিপদ থেকে। এই ৯ কম্যান্ডো বাহিনীকে যমের মত ভয় পায় সীমান্ত পাড়ের জঙ্গিরাও। জয় ভারতের কম্যান্ডো।