The News বাংলা, নিউ দিল্লি: নভেম্বরের ২৬ তারিখ পর্যন্ত পিছিয়ে গেল নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে জাকিয়া জাফরীর আবেদনের শুনানি। বিচারপতি এ.এম. খানউইলকর ও বিচারপতি দীপক গুপ্তার ডিভিশন বেঞ্চ সোমবার এই আদেশ দেয়।
ফের সমস্যায় পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চরম অস্বস্তিতে মোদী ও বিজেপি। সোমবারই গুজরাট দাঙ্গায় মোদীর জড়িত থাকার অভিযোগ শোনার কথা ছিল দেশের শীর্ষ আদালতের। বিচারপতিরা সেটা শুনবেন আগামী ২৬ তারিখ।
গুজরাট দাঙ্গার সময় আহমেদাবাদের গুলবার্গ হাউজিং সোসাইটিতে হামলা চালায় একদল উন্মত্ত জনতা। হামলা চালানো হয় ওই হাউজিংয়ে বসবাসকারী কয়েক হাজার মুসলমানের ওপর। অগ্নিসংযোগ করা হয় ওই আবাসনের বেশির ভাগ বাসাতেই। গণহত্যায় নিহত হন প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরী সহ ৬৯ জন মুসলমান। তাদের হাত পা কেটে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় বলে অভিযোগ।
আরও পড়ুনঃ ‘গুজরাট দাঙ্গা’, মোদীর বিরুদ্ধে জাকিয়ার অভিযোগ শুনবে সুপ্রিম কোর্ট
নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর। চার মাস পরেই গোধরা স্টেশনে ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রীকে ট্রেনে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। অভিযোগ ওঠে, কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই মোদী বলে দেন এটা পাকিস্তানের মুসলমানদের ষড়যন্ত্র। তিনি রাজ্যব্যাপী হরতালের ডাক দেন। আর আগুনে পোড়া তীর্থযাত্রীদের মরদেহ নিয়ে মিছিল করেন। উত্তেজক বক্তৃতাও দেন তিনি।
জাকিয়া জাফরীর অভিযোগ, তার পরের দিন হিন্দুদের একটি বিশাল দল নানা রকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গুজরাটের অভিজাত মুসলিম আবাসিক এলাকা গুলবার্গের সামনে জড়ো হয়। সেখানে থাকতেন কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরী।
পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা দেখে জাফরী আতঙ্কিত হয়ে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন স্থানে ফোন করতে শুরু করেন। অভিযোগ ওঠে, এঁদের মধ্যে মোদীও ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জাফরী নিরাশ হয়ে পড়েন। প্রাণভয়ে কংগ্রেস নেতার বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন অসংখ্য মুসলিম।
এর কিছুক্ষণ পরেই জাফরীর স্ত্রী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আতঙ্ক নিয়ে দেখেন, দাঙ্গাবাজরা তাঁর স্বামীকে নগ্ন করে টেনে রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছে। তার চোখের সামনেই তারা জাফরীকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে একে একে তাঁর আঙুল, হাত, পা, মাথা কেটে টুকরো টুকরো করছে। তারপর জাফরীর মৃতদেহকে তারা একটি উন্মুক্ত চিতায় ফেলে দেয়।
ওই ঘটনায় গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হন মৃত এহসান জাফরীর স্ত্রী জাকিয়া জাফরী। আহমেদাবাদের বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা, পুলিশ অফিসার ও সচিবের বিরুদ্ধেও সে সময় অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।
জাকিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে তদন্তে নামে গুজরাট দাঙ্গার বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। তদন্তে নেমে ৬৬ জনকে অভিযুক্ত করে সিট। এদের মধ্যে ৯ জন ১৪ বছর ধরে কারাগারে বন্দী রয়েছেন। বাকিরা জামিনে মুক্ত।
আরও পড়ুনঃ নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটে আর পড়াবেন না ‘দেশদ্রোহী’ প্রফেসর’
অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন রক্ষা পেয়েছিলেন এহসানের স্ত্রী জাকিয়া জাফরি। তিনিই মূলত অসীম সাহস নিয়ে এর বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত দিয়ে লড়াই চালাচ্ছেন গত ১৬ বছর ধরে। সবরকম সহায়তার হাত বাড়িয়ে তাঁর পাশে আছেন সমাজকর্মী তিস্তা শীতলাবাদ।
মোদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুতর। কিন্তু তিনি যথারীতি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন, এমনকি এও বলেন, সেদিন রাত সাড়ে আটটার আগে তিনি এ ঘটনা জানতেনই না। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমও (এসআইটি) তাঁর এই ভাষ্য সত্য বলে ধরে নেয়। ক্লিন চিট পান নরেন্দ্র মোদী।
গুজরাটের গুলবার্গ সোসাইটিতে এই গণহত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালত। ২০০২ সালে মুসলিমবিরোধী ওই দাঙ্গার সময় গুলবার্গ সোসাইটি কমপ্লেক্সে আক্রমণের পর কুপিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে অন্তত ৬৯ জন মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল।
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সোসাইটির অনেক ভবন। গুজরাট দাঙ্গা ছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গার ঘটনা। আহমেদাবাদের ওই বিশেষ আদালত তার রায়ে গণহত্যায় প্রত্যক্ষভাবে মদত দেওয়ার অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে কঠোর ও বাকি ১৩ জনের বিরুদ্ধে অপরাধের মাত্রা কিছুটা কমের কথা বলে।
দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে যে বিচার মিলেছে তাতে অভিযুক্ত ৬৬ জনের মধ্যে ৩৬ জনকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়। যে ২৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১৩ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্বল ধারা। বি জে পি বা বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেতারা বেশিরভাগই মুক্তি পেয়ে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই রায়ে বি জে পি তথা সংঘ পরিবার ছাড়া আর কারোরই সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্ন উঠছে এতবড় একটা আবাসন এলাকায় এত ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালানো কি মাত্র ২৪টা লোকের পক্ষে সম্ভব? যেখানে কয়েকশ হামলাকারী এই হত্যা ও ধ্বংস চালিয়েছিল তাদের সকলকেই প্রায় ছাড় দিয়ে মাত্র ২৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এটা কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না।
আরও পড়ুনঃ সিবিআই ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টে জোর ধাক্কা খেল মোদী সরকার
তদন্ত প্রক্রিয়ায় ঘাটতি, তদন্তকাজে সহযোগিতা না থাক এবং তথ্য গোপনের গভীর ষড়যন্ত্র না থাকলে এমন হওয়া একরমক অসম্ভব। তাছাড়া এতবড় একটা অমানবিক ঘটনা নিছক স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনায় ঘটেছে সেটাও বিশ্বাস করা কঠিন।
এইসব বিচার করেই ফের মৃত কংগ্রেস নেতার বিধবা স্ত্রীর অভিযোগ ফের শুনবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আর এতেই লোকসভা ভোটের আগে বেজায় সমস্যায় বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদী।