মাতৃভাষায় সরকারি কলেজে পড়াশোনা করে; বেশিদূর এগোনো যায়না। সরকারি স্কুল কলেজে পড়াশোনা মানেই, সব শেষ; মিলবে না চাকরি, ক্রাক হবে না ইন্টারভিউ। বাংলা হোক বা কেরল; ভাষা বাংলা হোক বা মালয়ালম; ধারণা অনেকটা এরকমই। আর এই ধারণাকে যখন কেউ ছুঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়; তাকে ব্যতিক্রম হিসাবে ঘোষণা করে আমরা চরম আনন্দ অনুভব করি।
ঠিক যেমন কেরালার রবীন্দ্রন; ১৯৮১ সালে কেরালার অ্যাজিকোডে জন্ম; যে গ্রামের নাম কেউ কোনদিন শোনেইনি। কেরালার একটি মালয়ালম স্কুলে রবীন্দ্রন এর পড়াশোনা; যেখানে মা ছিলেন অঙ্কের মাস্টার আর বাবা পড়াতেন ফিজিক্স। মধ্যবিত্ত মা-বাবার ছেলে রবীন্দ্রন ছাত্র হিসাবে ভালই ছিল; সুযোগ পেল কেরালার কান্নুরে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সেখান থেকেই করল বি টেক। ব্যাচেলর অফ টেকনোলজি মেকানিকাল ইন্জিনিয়ারিং; তারপর রাজ্যের একটি মাল্টিন্যাশনাল জাহাজ কোম্পানিতে পেয়ে গেল চাকরি।
সরকারি স্কুলে মাতৃভাষায় পড়েও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো চাকরি পাওয়া যায়; যোগ্যতা থাকলেই হল। এটা প্রমাণ হলেও রবীন্দ্রন এর গল্প এখানেই শেষ নয়; সবে তো শুরু।
চাকরি করতে করতেই ২০০৩ সালে রবীন্দ্রন ছুটির সময়; ক্যাট (CAT) পরীক্ষার্থীদের সাহায্য করতে শুরু করল। তারপর সে নিজেই CAT পরীক্ষায় বসল; সবাইকে অবাক করে পেল ১০০ শতাংশ নম্বর। পরের বছর সে আবার ওই CAT পরীক্ষা দিল; এবারেও সেই ১০০ শতাংশ নাম্বার। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রন যাদের যাদের এই পরীক্ষা প্রস্তুতিতে সাহায্য করত; তারাও করত দারুণ রেজাল্ট। অবাক কান্ড।
২ বছরের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে; পাকাপাকি-ভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কোচিং সেন্টার খুলে ফেলল রবীন্দ্রন। ছুটির সময় অবসরে সামান্য কিছু টাকার জন্য যেটা করত; সেটাই হল রবীন্দ্রন এর পেশা, শিক্ষকতা। শুরু করলেন Think & Learn কোচিং সেন্টার। পরবর্তীকালে যে কোম্পানির নাম হল; রবীন্দ্রন এর প্রথম নাম অনুযায়ী। বাইজু রবীন্দ্রন থেকে বাইজুস। শুরু হল মাতৃভাষায়, সরকারি কলেজে পড়া; Byju Raveendran এর জীবনের নতুন অধ্যায়।
১০, ২০, ৫০ থেকে ১০০; তারপর খেলার মাঠে। বাইজুস এর সাফল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে; বাড়তে থাকল ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা। এরমধ্যেই এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম; Byju Raveendran এর দুহাত মিলল Divya Gokulnath এর দুহাতের সঙ্গে। চার হাত এক হতেই কামাল; বাকিটা ইতিহাস।
২০১৫, স্মার্টফোনের স্ক্রিন সাইজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই; বাজারে এল বাইজুস এর অ্যাপ। পরের তিন বছরের মধ্যেই ভারত ছাড়িয়ে বাইজুস অ্যাপ ছড়িয়ে গেল; ব্রিটেন আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন ইংরেজি বলা দেশে। বর্তমানে আমেরিকার ফোর্বস ম্যাগাজিনের খবর অনুযায়ী; বাইজু রবীন্দ্রন এর সম্পত্তির পরিমাণ ২৫০০০ কোটি টাকারও বেশি। হ্যাঁ ঠিকই দেখছেন, পঁচিশ হাজার কোটি টাকা। ভারতের ৫০ জন ধনী ব্যক্তির অন্যতম।
জানুয়ারি ২০২১ এ ভারত সরকার; National Startup Advisory Council এর সদস্য করে বাইজু রবীন্দ্রন কে। অর্থাৎ গোটা দেশে যারা এই ধরনের নতুন স্টার্ট আপ ব্যবসা যারা শুরু করবেন; তাদের সাহায্য করবেন তিনি। সরকারি কলেজে পড়া ছাত্র।
বাইজুস টিউটোরিয়াল দিত, IIT-JEE, NEET, CAT এবং IAS; এছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল পরীক্ষা GRE, GMAT। ২০২১ এ ১০০ কোটি টাকা দিয়ে; বাইজুস কিনে নেয় আকাশ এডুকেশনাল সার্ভিস। এরপরেই শুধু বড়দের পরীক্ষা প্রস্তুতি নয়; শিশু শিক্ষার উপরও জোর দেয় বাইজুস। আর এখন বাইজুস পৌঁছে গেছে ভারতের ঘরে ঘরে; সব বাবা মার মোবাইলে।
উদোগী ও সাহসীদের ভাগ্যও সাহায্য করে; এটাই প্রবাদ। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ২০১৫ তে বাজারে এসেছিল বাইজুস এর অ্যাপ; সেই বছর থেকে বাড়তে শুরু করে স্মার্টফোনের স্ক্রিন সাইজ। ঠিক তেমন, বাইজুস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বে এল মহামারী করোনা; যার জেরে লকডাউন। টানা দু বছর বন্ধ স্কুল কলেজ; মোবাইল অ্যাপসেই আবদ্ধ পড়াশোনা।
কথাতেই আছে, কারো পৌষমাস, কারো সর্বনাশ; ২০২০ থেকে ২০২২, ফুলে ফেঁপে উঠল বাইজুস। শুধু ২০২১র শেষেই উপভোক্তার সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ কোটি। বছর নয়, প্রতিদিনের টার্নওভার আকাশ ছুঁল। ২০১৯ এর ১ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি; বর্তমানে ৩.২৫ বিলিয়ান ডলারের কোম্পানি।
বিশ্ব জুড়ে স্পোর্টস এও বিনিয়োগ শুরু করল সংস্থা। BYJU’S এই মুহূর্তে কাতারে হতে চলা ফিফা বিশ্বকাপের প্রধান তিন স্পনসরের অন্যতম; প্রায় ৪০ মিলিয়ান ডলার্সের বিনিময়ে। এছাড়া, ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি স্পনসর করে; প্রতি ম্যাচের জন্য ৪.৬১ কোটি টাকার বিনিময়ে। ISL ফুটবল দল কেরালা ব্লাস্টার্সেরও; টাইটেল স্পনসর বাইজুস।
মাতৃভাষায় ও সরকারি কলেজে পড়া ছাত্রটির টুপিতে; আসছে একের পর এক সম্মান। প্রতিটি পুরস্কার নিতে ভাষন দিয়েছেন; মাতৃভাষা ও ইংরেজিতে। ইংরেজি বলতে, পড়তে ও লিখতে কোন অসুবিধা হয় না; মাতৃভাষা ও সরকারি কলেজে পড়া ভারতীয় ছাত্রটির। যে হাভার্ড নিয়ে বাঙালি প্রায়ই আদিখ্যেতা করে; সেই হাভার্ড বিজনেস স্কুলে পড়ানো হয় বাইজুস অ্যাপ। ফেসবুকের সৃষ্টিকর্তা মার্ক জুকারবার্গ নিজেও বাইজুসের ইনভেস্টার।
২১, ২২, ২৩, তিন বছরে রবীন্দ্রন এর টার্গেট; আমেরিকা থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ও ব্রিটেন থেকে আরও ১ বিলিয়ন ডলার; মোট ২ বিলিয়ন ডলার আয় করার। ভারত থেকে কত উপার্জন করেন আর কত করবেন; সেটা প্রকাশ্যে কখনও বলেন না।
এবছরের মার্চেই ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যে; বাজার থেকে ৬০০০ কোটি টাকা (USD 800 million) তুলেছে বাইজুস। চাকুরীজীবী থেকে শিক্ষক ও এখন বিশ্বের একজন বড় উদ্যোগপতি; ছোটবেলায় মাতৃভাষা ও বড়বেলায় সরকারি কলেজে পড়েও। আমরা তর্ক-বিতর্ক চালিয়েই যাই; তার মধ্যেই রবীন্দ্রনের বাইজুস পৌঁছে যাবে ৪ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যে; ৪০ হাজার কোটির সম্পত্তি হবে রবীন্দ্রনের; আর ৮৬ শতাংশ মানুষ ফের সাবস্ক্রিপশন করে ফেলবেন বাইজুস অ্যাপ।
(লিখেছেন মানব গুহ)