একে ৪৭ এর গুলি বুকে নিয়েও কাসভকে ছাড়েন নি তুকারাম

808
The Newsবাংলা

একে ৪৭ এর সবকটা গুলি বুক ফুঁড়ে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেলেও, তাঁর হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারে নি পাক জ’ঙ্গী। তুকারাম ওম্বলের হাতই হয়ে উঠেছিল, আজমল কাসভের ফাঁসির ফাঁন্দা।

২৬,১১,২০০৮, ১৪ বছর আগে সেদিন রাতের শিফটে ডিউটি ছিল তুকারাম ওম্বলের। হালকা মেজাজে ভাবছিলেন কদিন পরেই শীতের আমেজ আসবে, মুম্বাই সেজে উঠবে উৎসবের মেজাজে। বান্দ্রা, জুহু, অন্ধেরি, সব জায়গা উঠবে ঝলমলিয়ে। ছেলেমেয়েরা ধরেছে শীতের ছুটিতে, কোথাও একটা যাবে।

হাসি পেল তুকারামের, পুলিশের আবার ছুটি। কোন উৎসবেই তাদের ছুটি চাওয়া পাপ। গণপতি উৎসব, দেওয়ালি, হোলি কিছুতেই মেলে না ছুটি। তবু পরিবারের মানুষেরা চায় তাকে। এবার একটা চেষ্টা করবে ছুটি নেবার।

The Newsবাংলা

ভাবতে ভাবতে মনটা পিছন ফিরে চলে গেল। সেই কবে আর্মিতে যোগ দেবার পর থেকেই, ছুটি বলে কিছু নেই জীবনে। তারপর কতদিন পেরিয়ে গেছে, খালি ডিউটি আর এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানো। বাড়ি থেকে কতো দূরে থাকতে হত, সেই সৈনিক জীবনে। কিন্তু সেই জীবনে একটা রোমাঞ্চ ছিল। দেশরক্ষার গর্ব গর্বিত করত। ঝুঁকি নিতে বেশ লাগত।

দেশপ্রেমটা তার মধ্যে চিরকালই বেশি। আর্মি থেকে অবসরের পর যোগ দেন, মুম্বাই পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর পদে। ঘর থেকে ডিউটি। নিরুপদ্রব জীবন, এতেই অভ্যস্ত হয়েছেন এখন। তাও মাঝে-মাঝে আর্মির সেই দিনগুলো মনে পড়লে রক্ত গরম হয়, জীবন চায় আবার অভিযান করতে। আবার তারপর মনে হয় এই বেশ, পরিবারকে সময় দেওয়া যাচ্ছে।

ভাবনার ছেদ পড়ল ইনস্পেক্টর ইন চার্জের উত্তেজিত কন্ঠে। ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস এ জ’ঙ্গী হানা হয়েছে। বহু মানুষ হতাহত। জ’ঙ্গীরা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, অ্যান্টি টেররিস্ট শাখার অফিসার হেমন্ত কারকারে, এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট বিজয় সালাসকারকে।

Image Source: Google

তাদের কোয়ালিস গাড়ি নিয়ে জ’ঙ্গীরা এদিকেই আসছে। অফিসার দ্রুত পজিশন নিতে বললেন সবাইকে। রক্ত গরম হয়ে উঠল ওম্বলের। ফোর্সকে রেডি হতে বলে, লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়।

এদিকে ইসলা’মিক ফি’দায়ে জ’ঙ্গী গোষ্ঠীর দুই সদস্য, আজমল কাসভ ও ইসমাইল খান শিবাজি টার্মিনাস এ হামলা চালিয়ে প্রচুর মানুষকে হ’ত্যা করে বাইরে বেরিয়ে এল। চারদিকে আতঙ্কিত মানুষের ছোটাছুটি, চিৎকার। ততক্ষণে হাই অ্যালার্ট জারি করেছে পুলিশ। হঠাৎ জ’ঙ্গিদের গাড়ির চাকা বার্স্ট করলো। তারা একটা অন্য গাড়ি দখল করে ছুটল। মুম্বাই পুলিশের অসহায় আত্মসমর্পণ আর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এর বহর দেখে মজা করতে লাগল তারা।

আরও পড়ুনঃ ‘কাসভের বেটি’, জঙ্গি চিনিয়ে দেবার ‘পুরষ্কার’ পাচ্ছে দেবিকা

বেশ মজা লাগল পাক জ’ঙ্গীদের। ভারতীয়গুলোর রক্ত দেখা পবিত্র কর্তব্য। আবার কয়েক রাউন্ড গুলি করল, জনগনকে লক্ষ্য করে। চিৎকার আরো বাড়ল। দেখা গেল একটা টয়োটা গাড়ি আসছে লাল বাতি লাগানো। পজিশন নিলো তারা। গাড়ি থেকে সালাস্কার, হেমন্ত কারকারে প্রমুখ নামতেই গুলিবর্ষণ শুরু করল। ঝাঁঝরা হয়ে গেল অফিসাররা। গাড়িটার দখল নিল কাসভ। গাড়ি ছুটল তাজ হোটেল লক্ষ্য করে।

বাহিনী নিয়ে রাস্তায় নাকা চেকিং করছে পুলিশ। সমস্ত গাড়িতে তল্লাশি চলছে। চৌপট্টি এলাকায় ডবল ব্যারিকেড করেছে পুলিশ। দেখা গেল তীর বেগে ছুটে আসছে একটি স্কোডা গাড়ি। আটকাতেই গাড়ি থেকে ছুটে এল গুলির ঝাঁক। পুলিশও গুলি চালাল। এক জ’ঙ্গী ঝাঁঝরা হয়ে গেল।

Image Source: Google

অপরজনের কাঁধে গুলি লাগল। সে চালাচ্ছিল গাড়ি। দ্রুত ইউ টার্ন নিল গাড়ি। এই সময় এক জ’ঙ্গির উপর, ঝাঁপিয়ে পড়লেন তুকারাম। একে জ্যান্ত ধরব। শরীরে ফুটছে আর্মি রক্ত। দেশপ্রেমের আদর্শ উত্তাল সমুদ্রের মতো উথাল পাথাল করছে। কানে বাজছে সেই মিলিটারি কমান্ডারের আদেশ, “দেশকি শত্রুও কো হাম নেহি ছোড়েঙ্গে। দেশ হামারে মা হ্যায়। মিট্টিমে মিলা দুঙ্গা দেশ কি শত্রুও কো”।

তুকারাম হাতের লাঠি দিয়ে সজোরে ঘা দিলেন গাড়ির দরজায়। এক হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললেন গাড়ির দরজা। টেনে ধরলেন তার বন্দুকের নল। ঝাঁপিয়ে পড়লেন জ’ঙ্গীর ওপর। আর তখনই জ’ঙ্গী গুলি চালাতে শুরু করল। বুকে পরপর ঢুকে যাচ্ছে বুলেট। রক্তে ভিজছে তার ইউনিফর্ম। বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে ছুটছে রক্তের ফোয়ারা।

Image Source: Google

কিন্তু লৌহকঠিন দুই হাত পেঁচিয়ে ফেলেছে জ’ঙ্গীর গলা। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছেন তাকে। যেভাবে ধৃতরাষ্ট্র কঠিন হাতে পিষে দিয়েছিল লোহার ভীমকে। যেভাবে শোলে ফিল্মে ঠাকুর, হাতের ফাঁসে ধরেছিলেন গব্বরকে। সেভাবেই আঁকড়ে ধরলেন কাসভকে। অক্টোপাসের নাগপাশ ছাড়াতে পারল না সে।

অন্য পুলিশরা ধরে ফেলল কাসভকে। বন্ধন আলগা হোল তুকারামের। দু হাত প্রসারিত করে, শুয়ে পড়লেন দেশের মাটির ওপর, ভারতমায়ের বুকে। ভলকে-ভলকে রক্ত ভাসিয়ে দিল তার জামা, তার পুলিশের ইউনিফর্ম। আকাঙ্ক্ষিত ছুটি মিলল তাঁর। তবে চিরদিনের মত। রাতটা ছিল ২৬/১১ সালটা ২০০৮। শহিদ হলেন তুকারাম ওম্বলে।

Image Source: Google

তাঁর অসম সাহসী এই লড়াই সেদিন ধরিয়ে দিয়েছিল, মুম্বই হামলার একমাত্র জীবিত জ’ঙ্গী কাসভকে। তার থেকে জানা গিয়েছিল, তার পাকিস্তানি পরিচয়। আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দেবার অকাট্য প্রমান পেয়েছিল ভারত।

সরকার সম্মান জানিয়েছিল এই বীর শহিদকে। প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁকে মরণোত্তর অশোক চক্র সম্মান দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রমান করেছিলেন দেশদ্রো’হীদের থেকে দেশপ্রেমিকদের ক্ষমতা অনেক বেশী। সম্মান জানাই তাঁকে। জয়হিন্দ। জয় তুকারাম ওম্বলে।

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন