দুই বাংলার মতুয়ারা মাতৃহারা হলেন। ভারত ও বাংলাদেশের একেশ্বরবাদী মতুয়া মহাসংঘের বড়মা বীণাপাণি দেবী মঙ্গলবার রাতে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার রাতে তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে বিকল হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন ডাক্তাররা। মঙ্গলবার রাতে প্রয়াত হলেন বড়মা। দুই বাংলার মতুয়া সমাজে শোকের ছায়া।
বীণাপাণি দেবী ভর্তি ছিলেন কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। গত কিছুদিন থেকেই ফুসফুসে সংক্রমণের সমস্যায় ভুগছিলেন ১০১ বছর বয়সী বড়মা। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় রবিবার তাঁকে কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতাল থেকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর চিকিৎসায় গঠিত হয় মেডিক্যাল বোর্ড। চিকিৎসকরা সর্বক্ষণ তাঁর শারীরিক অবস্থার ওপর নজর রাখছিলেন। কিন্তু সব আশা ব্যর্থ করে চলে গেলেন বড়মা। গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মতুয়া হিন্দুধর্মীয় একটি লোকসম্প্রদায়। গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দি নিবাসী হরিচাঁদ ঠাকুর প্রেমভক্তিরূপ সাধনধারাকে প্রচার করার জন্য যে সহজ সাধনপদ্ধতি প্রবর্তন করেন, তাকে বলা হয় ‘মতুয়াবাদ’। এই মতবাদের অনুসারীরাই ‘মতুয়া’ নামে পরিচিত। মতুয়া সম্প্রদায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। তারা বৈদিক ক্রিয়া-কর্মে আস্থাশীল নয়। তাদের ভজন-সাধনের মাধ্যম হচ্ছে নাম সংকীর্তন। তাদের বিশ্বাস ভক্তিতেই মুক্তি। এই সাধনপদ্ধতির মাধ্যমে সত্যদর্শন অর্থাৎ ঈশ্বরলাভই তাদের মূল লক্ষ্য।
গতবছরেই ঠাকুরনগর ঠাকুর বাড়িতে মতুয়াদের বড়মা বীণাপাণি দেবীর জন্ম শতবর্ষ উদযাপন করে তৃণমূল কংগ্রেস। মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপানি দেবীকে বঙ্গবিভুষণ সম্মানে সম্মানিত করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রয়াণে মাথার ওপর ছাদ হারালেন রাজ্যের অসংখ্য মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ।
বড়মার জন্ম বরিশালের জব্দকাঠিতে। ১৯৩৩ সালে বিয়ে হয় ফরিদপুরের ওড়াকান্দির প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের সঙ্গে। মতুয়া মহাসংঘের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুরের বংশধর প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে মতুয়ার নানা কাজের সঙ্গে যু্ক্ত হয়ে পড়েন বীণাপাণি ঠাকুর। স্বাধীনতার লড়াইয়ে যুক্ত ছিলেন প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। দেশ স্বাধীনের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন বীণাপাণি দেবীও।
১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হয়। সেই সঙ্গে হল দেশভাগও। বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ও পরিবারের সকলকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এলেন বীণাপাণি দেবী। চব্বিশ পরগনায় উদ্বাস্তু কলোনি গড়ে তুললেন। নাম হল ঠাকুরনগর। এখান থেকেই ক্রমে ছড়াতে থাকে মতুয়াদের মহাসঙ্ঘের কাজকর্ম।
১৯৯০ সালে স্বামী প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের মৃত্যুর পর মতুয়া মহাসংঘের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন বীণাপাণি ঠাকুর। হয়ে ওঠেন মতুয়াদের বড়মা। মতুয়াদের মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়ান তিনি। নানা বিপদে তিনিই হয়ে ওঠেন আশ্রয়, ভরসা। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন। কিন্তু বয়স বাড়ছিল। ক্রমে বার্ধক্যজনিত সমস্যাও বাড়ছিল।
বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকেই বেছে নিলেন তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে। ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। ২০১৪ তে মারা যান কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। বড় ছেলের পরিবার যখন তৃণমূলে, তখন ছোটছেলে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। রাজনীতিতে এসেছেন মমতাবালা ঠাকুর। বেড়েছে দুই ঘরের দূরত্ব। দুই রাজনীতির মানুষের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলেন বড়মা। তবুও বড়মা ছিলেন সবার।
২০১৮র দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে জন্মশতবর্ষ পালন করা হল বীণাপাণি ঠাকুরের। ২০১৮-র ১৫ নভেম্বর, তাঁকে বিশেষ বঙ্গবিভূষণ সম্মান দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে এই রাজ্যে এলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেখা করলেন বড়মার সঙ্গে।
শতবর্ষ পালন করা বীণাপাণি দেবীর শারীরিক অবস্থার ক্রমে অবনতি হতে থাকল। বাড়ছিল শ্বাসকষ্ট। ফু্সফুসে জল। হাসপাতালে ভরতি করা হল বড়মাকে। সারা জীবন লড়াই করে যাওয়া বড়মা লড়লেন। কিন্তু এবারের লড়াইয়ে হার স্বীকার করতে হল। মাথার উপর ছাদ হারাল কয়েক হাজার মতুয়া সদস্য। তিনি ছিলেন মতুয়াদের বড়মা। শুধু এপাড় বাংলা নয়, তাঁর মৃত্যুতে আজ চোখের জল ফেলছে ওপাড় বাংলাও।