The News বাংলা, কলকাতা: প্রায় ১২ বছর সম্পূর্ণ হতে চলল সিঙ্গুর আন্দোলনের। যে আন্দোলন রাজ্যে পট পরিবর্তনে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিল। ক্ষমতায় এনেছিল মা মাটি মানুষের সরকারকে। এবার সেই সিঙ্গুরেই গড়ে উঠবে শহীদ মিনার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর ইচ্ছে তেমনই।
এবার শহীদ মিনার সিঙ্গুরে। সিঙ্গুরের মাটিতেই ৪০ ফুট উঁচু শহীদ মিনার গড়তে চলেছে রাজ্য সরকার। সিঙ্গুরের কৃষক আন্দোলনকে স্মরণ করে তৈরী করা হবে এই মিনার। ইতিমধ্যে দরপত্র চেয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে পূর্ত দফতর।
আরও পড়ুনঃ মমতা দাওয়াই, থুতু-পিক ফেললেই ১০০ গুন বেশি জরিমানা
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে প্রায় ১ একর জমিতে গড়ে তোলা হবে এই শহীদ মিনার। এই মিনারের উচ্চতা হবে ৪০ ফুট। প্রাথমিকভাবে এই শহীদ মিনার তৈরি করার জন্য পূর্ত দপ্তর এর তরফ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে এবং আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ৬ কোটি টাকা। ৩০০ দিন ধার্য করা হয়েছে এই শহীদ মিনার তৈরীর জন্য, এমনটাই খবর নবান্ন সূত্রে।
সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরই কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন এবার সিঙ্গুরে তৈরি হবে বেশ কিছু স্মারক। যে জায়গা জুড়ে আন্দোলন হয়েছিল সেই জায়গাটিকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলা হবে। এমনকি তাপসী মালিকের নামেও একটি জায়গা কে চিহ্নিতকরন করা হবে।
আরও পড়ুনঃ জল অপচয় রোধে বাঙালি ছাত্রের আবিষ্কার ‘প্যাডেল ট্যাপ’
পাশাপাশি সেখানে থাকবে একটি তোরণ এবং স্মারক। ইতিমধ্যেই ঘোষণা মত সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে সিঙ্গুর আন্দোলনের বিষয়টি। নবান্ন সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র এর কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেলেই মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়ে যাবে। সামনের বছর জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের পরই এই কাজ শুরু করার চেষ্টা চালাচ্ছে রাজ্য পূর্ত দপ্তর, এমনটাই খবর নবান্ন সূত্রে।
আরও পড়ুনঃ মোদী অমিতের রথযাত্রার পর বাংলার শুদ্ধিকরণে মমতার পবিত্র যাত্রা
২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিশালভাবে জিতে ক্ষমতায় এসে, সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ১৮ মে ২০০৬, রতন টাটা এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের ঘোষণা করলেন। সেই মতো রাজ্য সরকার সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে। কিন্তু, অনেকেই জমি দিতে অস্বীকার করেন। সেই অনিচ্ছুক চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে নামে সেই সময়কার বিরোধী দল তৃণমূল।
দশ বছর আগে সরকারের একটা সিদ্ধান্তে শান্ত সিঙ্গুর বদলে গিয়েছিল আন্দোলনের অগ্নিভূমিতে। এক দশকের লড়াইয়ের পর সেই মাটিই লিখে দিয়েছিল কৃষক বিদ্রোহের অন্য আখ্যান। যাঁর নেতৃত্বে ছিলেন এক অগ্নিকন্যা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুনঃ পরকীয়া সমলিঙ্গে স্লোগান হারিয়ে দিশাহীন এইডস এর প্রচার
কারখানা হবে। একলাখি গাড়ি কারখানা। বহুফসলি জমিতেই হবে। সঙ্গে আছে ব্রিটিশ আমলের কৃষক-বিরোধী জমি অধিগ্রহণ আইন আর বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের আত্মবিশ্বাস। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভরসায় দু-হাজার ছয়ের মে মাসে সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা তৈরির কথা ঘোষণা করে টাটা।
সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকরা জানিয়ে দিলেন, গায়ের জোরে বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ তাঁরা মানবেন না। শুরু হল আন্দোলন। সিঙ্গুরের প্রতিবাদের মন বুঝতে দেরি করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে দাঁড়ালেন অনিচ্ছুক কৃষকদের।
এরপর ইতিহাস। তাপসী মালিক, রাজকুমার ভুলের মৃত্যু। সিঙ্গুরের লড়াইয়ের বার্তা কলকাতা-সহ গোটা দেশ, বিশ্বের কাছে পৌছে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিঙ্গুরের বিডিও অফিস থেকে তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে দিল বুদ্ধদেবের প্রশাসন।
ফিরে এসে মেয়ো রোডে অবস্থানে বসলেন তিনি। আড়াই মাস পর জোর করে জমি নেওয়ার প্রতিবাদে ধর্মতলায় তাঁর ২৬ দিনের আমরণ অনশন, সিঙ্গুরের আন্দোলনে এঁকে দিয়েছিল ল্যান্ডমার্ক।
২০০৭-এর গোড়ায় কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেছিল টাটা। কলকাতা হাইকোর্ট রায় দিল, সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণে ভুল করেনি বাম সরকার। তারপর, সোনার ফসল ফলানো মাটি আগলে রাখতে কঠিন লড়াই।
সে দিন অকুতোভয় সিঙ্গুরবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই মমতা। সিঙ্গুরের সানাপাড়ায় ধর্নায় বসেছিলেন মমতা। ১৫ দিনের ধর্নায় অবরুদ্ধ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল টাটারা। রাজভবনে তত্কালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর মধ্যস্থতায় বুদ্ধদেব -মমতা মুখোমুখি হলেও ভেস্তে গেল আলোচনা। ২০ অগস্ট ২০০৮, রাজভবনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক ব্যর্থ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় ন্যানোর অন্ধকার ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যায়।
আরও পড়ুনঃ জনগণকে ‘গাধা’ বানিয়ে ‘শিক্ষাগুরু নেহেরু’র যোগ্য ছাত্র সব রাজনীতিবিদ
৩ অক্টোবর ২০০৮, সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্প থেকে সরে গেল টাটা গোষ্ঠী। এরপর আরও আড়াই বছর ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট সরকার। যদিও, অনেকেই মনে করেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামই ছিল তাদের ওয়াটারলু। সিঙ্গুর সরণি বেয়েই মহাকরণে পৌছে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৩ মে ২০১১,
রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় এল তৃণমূল কংগ্রেস।
আরও পড়ুনঃ ‘অনুগ্রহ করে সব টাকা নিন’ বিজয় মালিয়ার টাকা ফেরতের সিদ্ধান্ত
প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েই মমতা জানিয়ে দেন, জমি ফেরাবেই তাঁর সরকার। জমি ফেরাতে ২০১১ র ১৩ জুন বিধানসভায় পাশ হল সিঙ্গুর জমি পুনর্বাসন ও উন্নয়ন বিল। টাটারা কলকাতা হাইকোর্টে গেলে সেপ্টেম্বরে সিঙ্গল বেঞ্চ রায় দেয় সিঙ্গুর আইন বৈধ। সিঙ্গল বেঞ্চের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় টাটা মোটর্স। দুহাজার বারোর জুনে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গুর আইন অবৈধ বলে রায় দেয়।
জমি ফেরাতে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জন্য দুটাকা কিলো দরে চালের ব্যবস্থা হয়। তারপর শুধুই অপেক্ষা। অবশেষে আগস্টের শেষ দিনে এল আনন্দের বার্তা। ৩১ অগস্ট ২০১৬, সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়। ‘২০০৬ সালে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ অবৈধ’।
সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ অবৈধ। অধিগৃহীত সব জমিই কৃষকদের ফিরিয়ে দিতে হবে। ২০১১ র পর ফের বড় জয় মমতার। এরপর সবুজ আবির, মিষ্টি মুখ, অকাল দোল। দুর্গতিনাশিনীর পুজোর আগেই যেন দুর্গতিনাশ হল সিঙ্গুরে।
আরও পড়ুনঃ সাধারণ মানুষের জীবনের দাম এখন কুকুর ছাগলের চেয়েও কম
২০০৭ এর এক সেপ্টেম্বরে সিঙ্গুরের সানাপাড়ায় জোর করে জমি নেওয়ার প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছিলেন মমতা। সেই একই জায়গায় ২০১৬ র সেপ্টেম্বরে তিনি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মাথায় নিয়ে ফিরিয়ে দিলেন কৃষকের জমি। এত বছর ধরে যাঁরা ক্ষতিপূরণ নেননি, তাঁদের হাতে তুলে দিলেন চেক।
সম্পূর্ণ হয় বৃত্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে লেখা হয় কৃষক বিদ্রোহের নতুন গল্প। একটা আন্দোলনের নাম হয়ে গেল সিঙ্গুর। আর এবার সেই সিঙ্গুর আন্দোলনের এক যুগ পূর্তীতে রাজ্যবাসীর মনে সেই স্মৃতি গেঁথে দিতে মমতা তৈরি করবেন শহীদ মিনার। চিরস্থায়ী হবে এক যুগের ইতিহাস।