শেষ পর্যন্ত সব জল্পনার অবসান৷ বিজেপিতে যোগ দিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রাক্তন পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ৷ সোমবার দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরে গিয়ে তিনি গেরুয়া শিবিরে যোগ দেন। মুকুল রায়, কৈলাশ বিজয়বর্গী ও রবিশঙ্কর প্রসাদের উপস্থিতে বিজেপিতে যোগ দিলেন তিনি।
গত অগাস্টেই একটি অডিও বার্তায় নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছিলেন ভারতী ঘোষ। তিনি জানিয়েছিলেন, খুব শীঘ্রই রাজনীতিতে যোগ দিতে চলেছেন তিনি। মুকুল রায়ের হাত ধরে বিজেপির সঙ্গে যে সখ্যতা বাড়ছিল, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
“মমতাই আমার মা”, হাঁ একসময় প্রকাশ্য মঞ্চে মমতাকে মা বলেছিলেন তিনি। সেইসময় মমতার ঘনিষ্ঠ ভারতী ঘোষ ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি। তবে সেই সম্পর্ক বেশিদিন মধুর হয়নি৷ তাঁর বিরুদ্ধে জোর করে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে৷
আরও পড়ুনঃ সিবিআই অফিসারদের বউ বাচ্চাদের হেনস্থা কলকাতা পুলিশের, রিপোর্ট রাজ্যপালের
এছাড়া ভারতীর দেহরক্ষী সুজিত মণ্ডলের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে৷ সুজিতকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর অবশ্য ভারতী চাকরি থেকে ইস্তফা দেন৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি একাধিক অভিযোগও জানিয়েছিলেন৷ ২০১৭ সালেই চাকরি থেকে ইস্তফা দেন ভারতী।
আরও পড়ুনঃ সারদা কেলেঙ্কারির পাল্টা এবার সিবিআইকেই প্রতারণা মামলার নোটিশ মমতার পুলিশের
এদিন যখন সিবিআই-এর প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেইসময় অন্যদিকে বিজেপিতে যোগ দিলেন ভারতী। ভারতী একটানা ছয় বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। তিনি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত কাছের লোক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মা’ বলে ডাকতেন। প্রকাশ্যেও তিনি মমতাকে মা সম্বোধন করতেন।
রাজনীতিকেরা বলেন, মমতার সঙ্গে ভারতী ঘোষের সুমধুর সম্পর্কের জেরেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়ে ছিল ভারতী ঘোষের একচ্ছত্র আধিপত্য। বিরোধীদের অভিযোগ, তিনি ছিলেন তৃণমূলের এক অপ্রকাশ্য নেত্রীও। দলকে গোছানো, দলকে বাড়ানো, অন্য দল ভাঙা, কাউকে দলে আনা, এসবের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
আরও পড়ুনঃ মমতার নির্দেশে সিবিআই অফিসারদের আটক করে বাংলার আইপিএসরা বিপদে
এর ফলে এই পশ্চিম মেদিনীপুরে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল তৃণমূলের। এ জন্য তিনি ছিলেন মমতার নয়নমণি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১৬ সালের রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলের চাপের মুখে ভারতী ঘোষকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেয় ভারতের নির্বাচন কমিশন। তবে আবার নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতী ঘোষকে স্বপদে ফিরিয়েও আনেন। এতে মমতা বা তৃণমূলের সঙ্গে ভারতী ঘোষের সুসম্পর্কের দিকটি স্পষ্ট হয়ে যায়।
আরও পড়ুনঃ তথ্যপ্রমাণ নষ্টের প্রমাণ পেলে পুলিশ কমিশনারকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে হুঁশিয়ারি সুপ্রিম কোর্টের
শুধু মমতা কেন, মমতার দলের সেই সময়কার দ্বিতীয় শক্তিশালী নেতা মুকুল রায়ের সঙ্গেও ছিল ভারতী ঘোষের সুসম্পর্ক। মমতা বা মুকুল রায়ের সঙ্গে এই সুসম্পর্কে ছেদ ঘটে মুকুল রায়ের বিজেপিতে যোগদানের পর। অভিযোগ ওঠে, মুকুল রায় বিজেপিতে যোগদানের পর ভারতী ঘোষ নাকি মুকুল রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। এটা মেনে নিতে পারেননি মমতা ও পূর্ব মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতা ও রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী। এরপর শুরু হয় ওই মন্ত্রীর সঙ্গে ভারতী ঘোষের ঠান্ডাযুদ্ধ।
আরও পড়ুনঃ পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে সিবিআইকে ঢুকতে বাধা কলকাতা পুলিশের
এই সময়ই হঠাৎ করে ভারতী ঘোষের পদাবনতি ঘটিয়ে পুলিশ সুপারের পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে বদলি করা হয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরের পুলিশের তৃতীয় ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার পদে। এটাই মেনে নিতে পারেন নি ভারতী ঘোষ। তিনি নতুন পদে যোগ না দিয়ে পদত্যাগ করেন। আবেদন করেন স্বেচ্ছা-অবসরের। এই কারণে সম্পর্ক শেষ হয় মমতার সঙ্গে। জোরালো হয় মুকুল রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক। শুরু হয় ভারতী ঘোষকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নতুন রাজনীতি।
আরও পড়ুনঃ বুদ্ধে সৌজন্য কিন্তু মোদী যোগীতে অনুমতি নেই, শত্রু পাল্টেছে মমতার
তাঁকে নাস্তানাবুদ করার জন্য মামলা হয়, বলেই অভিযোগ ছিল ভারতী ঘোষ এর। সিআইডিও ভারতী ঘোষের অবৈধ সম্পত্তির খোঁজে নেমে পড়ে। তল্লাশি চালানো হয় কলকাতার আনন্দপুরে ভারতী ঘোষের তিনটি বাড়িতে। এই তল্লাশির পরই সিআইডি দাবি করে, তাঁর আস্তানা থেকে উদ্ধার হয়েছে নগদ আড়াই কোটি টাকার নতুন নোট। এ ছাড়া অন্যান্য সামগ্রী।
আরও পড়ুনঃ যোগী আদিত্যনাথকে আদৌ বাংলায় নামার অনুমতি দেবে মমতা ব্যানার্জী সরকার
সিআইডি ইতিমধ্যেই ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করেছে। মামলা চলছে ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে। বসে ছিলেন না ভারতী ঘোষও। তিনি ও তাঁর স্বামী এই ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেন। এরপরেই ভারতী ঘোষকে বিজেপিতে নেওয়ার জন্য তৎপরতা শুরু করে দেয় বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় এবং রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বৈঠকও করেন ভারতী ঘোষ।
সোমবার শেষ পর্যন্ত বিজেপিতেই যোগ দিলেন তিনি। বলা হচ্ছে মমতার প্রতিহিংসা থেকে বাঁচতেই বিজেপিতে ভারতী। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ভারতী ঘোষ কি রেহাই পাবেন দুর্নীতির সব অভিযোগ থেকে? নাকি বিজেপিতে যোগ দিয়ে মমতাবিরোধী অস্ত্র হবেন? তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও মামলাগুলোর কি হবে?