“মমতার চাকরির অফার লেটার দুর্নীতি”, রাজ্য সরকার কোম্পানির লেটারহেড জাল করেছে। “চাকরির অফার লেটার, পুরোটাই ঢপ”, প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ করছেন মানুষজন। কি অভিযোগ উঠে আসছে? নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১১০০০ কারিগরী শিক্ষা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের চাকরির অফার লেটার তুলে দিয়েছেন। আগামী ১৫/০৯/২২ খড়্গপুরে, ২১/০৯/২২ দুর্গাপুরে,২২/০৮/২২ শিলিগুড়িতে একইরকম সরকারি অনুষ্ঠানে, আরও ১৯০০০ জনকে চাকরির অফার লেটার দেওয়া হবে বলে সংবাদমাধ্যমে জানাচ্ছে। শিক্ষক দিবসে যে ৩০০০০ চাকরির ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন, সেটা দুধর্ষ-দুরন্ত গতিতে রূপায়িত হচ্ছে বলেই বাংলার সব মিডিয়া তারস্বরে প্রচার করছে। কিন্তু সত্যিটা কি? বাস্তবটা ঠিক কি?
৫ জন ছাত্রছাত্রীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে, বাস্তব তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষ। হাওড়া, হুগলী, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা-এই পাঁচ জেলা থেকে ১০১০০ জন কারিগরী শিক্ষা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের বাস বোঝাই করে, চাকরি দিতে ভিড় করান হল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। মুখ্যমন্ত্রী এলেন, মাইক ধরলেন। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নানান বাগাড়ম্বরের পর, ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলেন তারা অফার লেটারের ই-মেল পেয়েছে কিনা। স্তব্ধ স্টেডিয়াম। কিন্তু অকুতোভয় ভঙ্গিতে, তিনি বারবার জানতে চাইলেন।
শেষে ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে জানালো-‘না, পাইনি’। বিড়ম্বনা এড়াতে পোডিয়াম ছেড়ে, মঞ্চজুড়ে পায়চারি করতে শুরু করলেন তিনি। তারপর আধিকারিকদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে জানালেন, ই-মেল আজকে (১২/০৯/২২) থেকে যাবে। এই কথা শুনে ও মুখ্যমন্ত্রীর বিভ্রান্তি দেখে, ছাত্রছাত্রীরা হাসি চাপতে পারল না। ‘বাসে-বাসে খাবারের প্যাকেটের সঙ্গেই, দিতে হবে অফার লেটার’-আমলাদের উদ্দেশ্যে এই নির্দেশ দিয়ে তিনি মঞ্চ ছাড়লেন। ১৫ মিনিট পরে আমলারা অসহায় ভঙ্গিতে, ফেরার বাস ছাড়ার হুকুম দিয়ে দিলেন। চাকরির অফার লেটার, সেই বাসে উঠতে পারলো না।
সংবাদমাধ্যম মুখ্যমন্ত্রী বিদায় নিতেই, হেডলাইন লিখে দিল। বাংলা জানল মুখ্যমন্ত্রী মমতা ১১০০০ চাকরি দিয়ে দিয়েছেন। আরও দেবেন, মোট ৩০০০০। কিন্তু বাস্তবে যে অফার লেটার, বাস মিস করেছে সেটা সংবাদমাধ্যম চেপে গেলো। ভোর চারটেয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে, রাত আটটায় বাড়ি ফেরা ছাত্রছাত্রীদের শরীরে ক্লান্তি, মনে একরাশ বিভ্রান্তি ছিল, কিন্তু হাতে অফার লেটার ছিল না।
অপেক্ষাও শেষ হল পরদিন, ১৩/০৯/২২ তারিখে রাতে। চাকরির অফার লেটার নিতে, ওদের ডাক পরল হুগলী নোডাল অফিসে। সেখানকার কর্মীরা রাতেও অন-ডিউটি। ১৪/০৯/২২ সকাল ১০টার আগে, অফার লেটার ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিতেই হবে। রাত সাড়ে নটা নাগাদ, ওরা হাতে পেল বহু-প্রতিক্ষীত অফার লেটার।
কিন্তু লেটার খুলে তো, ওদের চক্ষু চড়কগাছ। কোথায় চাকরি? লেটারে লেখা আছে, সুজুকি মোটরস্ গুজরাট এবং ফানফিস্ট গ্লোবাল স্কিলার্স-এর যৌথ ব্যবস্থাপনায়, ২ বছরের আইটিআই শিক্ষাক্রমে ট্রেনিং পার্টনার হিসেবে তাদের যুক্ত করা হচ্ছে। মাসিক স্টাইফেন পাবে ১১০০০ টাকা। ওদের কোর্স ফিজ সুজুকি মোটর্স গুজরাট প্রাইভেট লিমিটেড বহন করবে। যে তালিকায় ওদের নাম আছে, সেখানে আরও ১০২ জনের নাম আছে। মোট ১০৭ জন।
এখানেই যন্ত্রণার শেয নয় এদের। চিঠিতে স্পষ্ট লেখা আছে ১১/০৯/২২ থেকে ১৪/০৯/২২ সকাল ১০টার মধ্যে, গুজরাটের সুরেন্দ্রনগরে গিয়ে ওদের জয়েন করতে হবে। মানে হাতে চিঠি পাওয়ার ১২ ঘন্টার মধ্যে, ২০৫০ কিমি দূরে গুজরাতে গিয়ে ওদের জয়েন করতে হবে। সঙ্গে এটাও লক্ষণীয় জয়েনিং ১১/০৯/২২ থেকে শুরু হয়ে গেলেও, শুধুমাত্র মমতার মুখ থেকে সরকারি মোচ্ছবের মাধ্যমে ঘোষণার জন্য, মাত্র ১২ ঘন্টা আগে তা দেওয়া হল।
জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীর সেটুকু সময়ও পাবে না। কারণ ওদের পক্ষে ১৩/০৯/২২-এ ৮টায় খবর পেয়ে আর হুগলী নোডালে আসা সম্ভব নয়। ওরা এই অফার লেটার পাবে ১৪/০৯/২২ সকালে আর সেইদিনই জয়েনিং তাও গুজরাতে। অফার লেটারের নামে প্রহসনপত্র তুলে দেওয়া হল, ছেলেমেয়েদের হাতে। ১৪/০৯/২২ সকাল ১০টায় জয়েনিং-এর সময়সীমা শেষ, তাই তার আগেই বাধ্যতামূলক-ভাবে অফার লেটার সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
চমকের কিছু তখনও বাকি ছিল। এই অবস্থায় ক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা চিঠিতে দেওয়া নম্বরে, সেন্টার ইনচার্জ হিসেবে উল্লেখিত বেদপ্রকাশ সিং-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, “সম্পূর্ণ চিঠিটাই ফেক বা ভুয়ো। চিঠিতে উল্লেখিত কোম্পানি আছে, তারা স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য আইটিআই-এর কোর্স করান, সুজুকি মোটর্সের সাথে তাদের টাইআপ আছে, নিযুক্তদের তারা এই লেটারহেডেই চিঠি পাঠান, এগুলো সবই সত্যি। কিন্তু লেটার হেডটি রঙিন হয়, এই রকম সাদাকালো নয়। এক্ষেত্রে তাদের লেটারহেড অন্যায়-ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
রাজ্যের বেকার যুবক-যুবতিদের সঙ্গে, এই নির্মম রসিকতা কেন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্য সরকার? প্রশ্ন তুলেছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। The News বাংলার তরফ থেকে বেদপ্রকাশ সিং-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তিনি পরিস্কার বলে দেন, “অফার লেটার পুরোটাই জাল। অফার লেটার জাল করে, ভুয়ো চাকরির নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নিচ্ছেন”। শুধুমাত্র নিজের প্রচারের জন্য, ছাত্র-ছাত্রীদের এইভাবে প্রতারিত করল রাজ্য সরকার আর তাদের প্রধান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ।