১৫ বছর পর আই লীগের দুটি ডার্বি ম্যাচেই মোহনবাগানকে হারাল ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচ পরিকল্পনায় বাগান কোচ খালিদ জামিলকে টেক্কা দিলেন লাল হলুদের অ্যালেসান্দ্রো মেনেন্ডেজ গার্সিয়া। রবিবাসরীয় ডার্বির রং লাল হলুদ।
আই লিগে শুধু নয়, অ্যালেসান্দ্রো মেনেন্ডেজ গার্সিয়ার প্রশিক্ষণে এখনও পর্যন্ত যা খেলেছে ইস্টবেঙ্গল, তাতে আজকের ম্যাচ অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে সেরা। ফুটবল মহল বলছে, “অ্যালেসান্দ্রোর ছেলেরা আজ বুঝিয়ে দিয়েছে, ইংরেজিতে “মিথ” আর “পারসেপশন”, দুটো ভিন্নার্থক শব্দ। ‘সোনি নর্ডি খেললে মোহনবাগান হারে না’, এই মিথ যে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এতদিন, তার সলিল সমাধি হল রবিবার বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে।
শুধু এগারোজন লাল-হলুদ নয়, পরিবর্তন হিসেবে নেমে ব্র্যান্ডন লালরেমডিকা যে খেলাটা খেলল, তা চোখে লেগে থাকবে অনেকদিন। প্রথম একাদশে কমলপ্রীতকে মরসুমে প্রথম নিজের জায়গায় খেলতে দেখা গেল। নিজের জায়গায় ও যে এখনও কতখানি ভাল, তা আজ বারবার প্রমাণিত করল এই পাঞ্জাব তনয়। ওর এমন খেলায়, মনোজ মহম্মদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রবিবাসারীয় ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের একমাত্র বাঙালি ফুটবলার সামাদ আলি মল্লিক মাঠে নেমেছিল ৮৭ মিনিটে, বাকি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কেউ বাঙালি নন। কিন্তু তাও, লাল হলুদ জার্সির আবেগটা বুঝতে এতটুকু ভুল হয়নি, লালরামচুল্লোভা পৌতো, লালরিংডিকা রালতে, জনি অ্যাকোস্তা জামোরা, টনি ডোভালে, খাইমে স্যান্টোস কোলাডো, কিংবা বোরখা গোমেজ পেরেজদের।
ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে পাঁচ থেকে ছটি ছকে খেলে বিপক্ষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার কাজটা করেছে। সবুজ মেরুনের সেই সোনি নর্ডি নির্ভর ফুটবল আটকে দিলেই যে ম্যাচ হাতে আসবে, সেটা বুঝতে ভুল করেন নি সাহেব কোচ। আর রবিবার, ঠিক সেই কাজটাই করল অ্যালেসান্দ্রোর ছেলেরা।
রিয়েল মাদ্রিদ বি দলের প্রাক্তনীর নির্দেশই ছিল, বক্সে ঢুকেই যে গোলে শট নিতে হবে তার কোনও মানে নেই। তাই শুরু থেকেই লাল হলুদের ফুটবলাররা বক্সের বাইরে যেখানে বল পেয়েছে, সেখান থেকেই শট নিয়েছে গোলমুখে। আর ৩৪ মিনিটে যেই সুযোগ পেয়েছে, কোলাডোর জন্য নিখুঁত পাস বাড়িয়ে দিয়েছে জবি। কোলাডোও গোলে বল রাখতে ভুল করেনি।
সোনি, ডিকা, হেনরিকে নামিয়ে আক্রমণে শক্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল মোহনবাগান কোচ। পারেননি, কেননা একার দায়িত্বে হাইতিয়ান তারকাকে বোতলবন্দি করে দিল লালরাম চুল্লোভা পৌতো। এমনভাবে ট্যাকেল করতে লাগল চুল্লোভা, যে সোনি শুধু বিষমাখানো কর্ণার করাই নয়, ভুল করতে লাগল ফ্রিকিক নিতে গিয়েও।
আর সেখানেই শেষ মোহনবাগান। খালিদ বরঞ্চ এক স্ট্রাইকারে খেলে ইউতাকে নামালে অনেক বেশি জায়গা তৈরি করতে পারতো ইস্টবেঙ্গল অর্ধ্বে। প্রথম চালেই তাই ভুল করে ফেলল মুম্বইকর প্রশিক্ষক।
ম্যাচ যত এগিয়েছে, বাগান রক্ষণে গলায় ফাঁসের মতো চেপে বসেছে লাল হলুদ আক্রমণ। একের পর এক আক্রমণের ঝড়ে তখন বেসামাল পালতোলা নৌকা। এর মাঝে, হঠাৎই ইস্টবেঙ্গল জালে বল ঢুকিয়ে দেয় ডিকা। অবশ্য লাইন্সম্যান অফসাইডের পতাকা তোলায়, সেই গোল নাকচ করেন রেফারি শ্রীকৃষ্ণ।
রিপ্লে দেখে মনে হয়েছে, গোলে ঢোকার আগে বল হাতে লাগে মোহন ফুটবলারের। তাছাড়া, দুই ফুটবলার অফসাইডেও থাকায়, গোল বাতিল নিয়ে বেশি আবেদন নিবেদনের পথে আর যায়নি সবুজ মেরুন ব্রিগেড। এরপর আবার ডিকার কর্ণার থেকে হেডে বিশ্বমানের গোল জবির। মাঝে দুটো ম্যাচে একটু অফফর্মে ছিল আই এম বিজয়নের এই ভক্ত। আক্রমণ ভাগে মাঝে মাঝে একা পড়ে যাচ্ছিল বলে। তবে আজ আর তেমনটি হয়নি। যোগ্য সঙ্গত করে গিয়েছে কখনও খাইমে, কখনও ডোভালে, কখনও ডানমাওইয়া রালতে।
দ্বিতীয় অর্ধ্বে ডানমওইয়াকে বসিয়ে ব্র্যান্ডনকে মাঠে নামিয়ে মোহনবাগান ডিফেন্সের ওপর আরও চাপ বাড়িয়ে দেন অ্যালেসান্দ্রো। মোহনবাগান তখন দিকশূন্য। এতটাই করুণ অবস্থা যে চুল্লোভাকে আটকাতে গিয়ে হলুদ কার্ড দেখতে হয় মোহনবাগান অধিনায়ক সোনি নর্ডিকে। পুরো মোহনবাগান দল তখন কোথায় আক্রমণ করবে, না পুরো এগারোজন নেমে ডিফেন্স করে চলেছে।
জনি আর বোরখা জুটি যতদিন যাচ্ছে তত দুর্ভেদ্য হয়ে উঠছে। কোনও শব্দই ওদের প্রশংসার যোগ্য নয় আজ যে খেলাটা খেলেছে ওরা দুজনে। সঙ্গে কাসিম আয়দারা। মোহনবাগানের মাঝমাঠের খেলাটাই নষ্ট করে দিয়েছে ও একার দায়িত্বে। একজন অসাধারণ হয়ে ওঠে একজন অসাধারণ প্রশিক্ষকের হাতে পড়েই। ইস্টবেঙ্গলের সকলে তা আজ ৯৪ মিনিট, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে, বলছেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা।
চেন্নাইয়ের সঙ্গে পয়েন্ট টেবিলে ফারাক মাত্র পাঁচ পয়েন্টর। আগামী দিনে চেন্নাইকে কিন্তু খেলতে হবে মোহনবাগান, চার্চিল ব্রাদার্স আর রিয়েল কাশ্মীরের বিরুদ্ধে। আশায় বুক বাঁধতেই পারে লাল হলুদ।
সৌজন্যেঃ
লেখাঃ শান্তনু সরস্বতী/ছবিঃ সৌমিক দাস