১৯৯১ সালে ৩ জানুয়ারি Anthropological Survey of India-এর তখনকার গবেষক মধুমালা পা রাখেন সেন্টিনেল দ্বীপে। তাদের প্রাথমিক তিরের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তারপর তাদের সঙ্গে সফলভাবে বন্ধুত্ব করতে পেরেছিলেন তিনি। সেই প্রথমবার কেউ পা দিলেন নিষিদ্ধ জারোয়া দ্বীপে।
জারোয়াদের দ্বীপে এক জারোয়া মায়ের অনুমতি নিয়ে তিনমাসের এক শিশুকে কোলেও নেন। ছ’বছরের গবেষণার শেষে মধুমালা লেখেন, ‘ওই আদিবাসী মানুষগুলো হয়তো প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে, কিন্তু সামাজিকভাবে তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে’।
আরও পড়ুনঃ বাংলা ফিল্মের জনপ্রিয় পরিচালকের রহস্যমৃত্যু
আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক।
দিনটা ছিল ১৯৯১ সালের ৩ জানুয়ারি। রাতে এম ভি তারমুগলি জাহাজে করে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হই আন্দামান ও নিকোবর প্রশাসনের উপজাতি কল্যাণ বিভাগের অধিকর্তা এস আওয়ারাদি, ডাক্তার অরুণ মল্লিক, সাধারণ পোশাকে দশ নিরাপত্তারক্ষী এবং আমি। পর দিন সকাল আটটা নাগাদ প্রচুর নারকেল নিয়ে একটি সরকারি নৌকায় চেপে আমরা এগিয়ে যাই দ্বীপের দিকে। প্রথমে চোখে পড়ে কয়েকটি কুঁড়েঘর।
আরও পড়ুনঃ পাকিস্তানের কোপে এবার প্রিয়াঙ্কা চোপড়া
খানিক পরে সমুদ্রতীরে দেখা গেল অল্প কিছু সেন্টিনেলিকে। তাদের মধ্যে কয়েক জনের হাতে তির-ধনুক। জাহাজ দ্বীপের যত কাছে যেতে লাগলো, তাঁদের কিছুটা ভয়-ভয় করতে লাগলো! তবে, মধুমালা একটুও না ঘাবড়ে একটা একটা করে নারকেল গড়িয়ে দিতে থাকলেন সেন্টিনেলিদের দিকে। অন্য দিকে তারাও আহ্লাদের সঙ্গে সেগুলো কুড়িয়ে নিতে থাকে।
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ১৯৮৯ সালে তিনি যখন আন্দামান এসেছিলেন, সেখানে ‘ওঙ্গে’ উপজাতিদের নিয়ে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল মধুমালার। তাদের ভাষাও কিছুটা রপ্ত করেছিলেন, এমনকি কিছু সাংকেতিক শব্দ বা ইঙ্গিত তিনি বুঝতে পারতেন। তার উপরে ভরসা করে মধুমালা যখন সেন্টিনেলিদের উদ্দেশে বললেন, ‘কাইরি ইচেইরা’ মানে দাঁড়ায়- ‘আমি তোমাদের মায়ের মতো, এ দিকে এসো’। তার উত্তরে কয়েকজন সাড়া দেয়! ‘নারিয়ালি জাবা, জাবা- মানে আরও নারকেল পাঠাও’। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ততক্ষণে নারকেলের ভাণ্ডার প্রায় শেষ।
আরও পড়ুনঃ মানুষের হুমকিতে বাংলায় ভূতেদেরও কথা বলার অধিকার কাড়া হল
অত:কিম, ওই দিনই দুপুর দুটো নাগাদ চটের বস্তায় করে প্রচুর নারকেল নিয়ে আবার আসা হলো মধুমালার নেতৃত্বে। এইবার তাঁরা আরো একটু সাহস সঞ্চয় করে আরও কাছাকাছি গেলেন। নারকেল বিতরণের সময় অনেক সেন্টিনেলিরা এসে নিলো। কিন্তু এল না শুধু একজন। আঠারো-উনিশ বছরের এক তরুণ দূর থেকে মধুমালাকে লক্ষ্য করছিলো! হটাৎ সে মধুমালার উদ্দেশে তীরের নিশানা করতেই তাকে ধাক্কা দেয় এক সেন্টিলেনি মহিলা।
তাদের নিশানা অব্যর্থ! কিন্তু ধাক্কার ফলে সেই বিষ মাখানো তীর জলে পড়ে যায়! ভাগ্যিস…. সেই মহিলা সেদিন তাঁর ত্রাতা হয়েছিলেন নাহলে…..। এই ঘটনায় একটু হকচকিয়ে গেলেও এই প্রথমবার সফল হল এই নিষিদ্ধ দ্বীপে ‘গিফ্ট ড্রপিং’ অভিযান। মধুমালার মতে, হয়তো সরকারি দলে এক মহিলার উপস্থিতি ওই উপজাতিদের বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছিল।
আরও পড়ুন: পরিচালক মৃণাল সেনের ফিল্ম পরিচালনার কিছু ‘মণি মুক্ত’
১৯৯১ সালের আগেও ১৯৭৬ সালে বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ টি এন পণ্ডিতের নেতৃত্বে একটি দল ওই দ্বীপে যায়, কিন্তু সেই অভিযান সফল হয়নি। তবে ১৯৯৬ সালে টি এন পণ্ডিতের নেতৃত্বে আবার ওই দ্বীপে অভিযান হয়েছিল। যার সাথে ছিলেন মধুমালা চট্টোপাধ্যায়। যাতে তাঁকে সহজে চিনতে পারে তাই আগেরবারের মতোই তিনি পরেছিলেন নীল চুড়িদার ও সাদা ওড়না। এ বার নারকেল নিতে সেন্টিনেলিরা সরাসরি নৌকাতেই উঠে আসে।
মধুমালার সৌভাগ্য যে তিনি এই দ্বীপপুঞ্জের ছ’টি উপজাতি- ‘গ্রেট আন্দামানিজ’, ‘ওঙ্গে’, ‘জারোয়া’, ‘সেন্টিনেলি’, ‘শম্পেন’ এবং ‘নিকোবরিজ’ প্রত্যেককে নিয়ে কম-বেশি কাজ করেছেন। এর জন্য সফর করেছেন প্রত্যেকটি উপজাতির মূল আবাসস্থলে। লিটল আন্দামান থেকে মিডল আন্দামান, গ্রেট নিকোবর থেকে কার নিকোবর সর্বত্র তাঁর পদচিহ্ন রয়েছে।
আরও পড়ুন: বছর শেষে আবার ইন্দ্রপতন, প্রয়াত চিত্র পরিচালক মৃনাল সেন
সেখানে তিনি পরিচিত ‘জংলি ম্যাডাম’ এই নামে। তিনি এই বিষয়ে প্রকাশ করেছেন কুড়িটি গবেষণাপত্র। তাঁর লেখা বই ‘ট্রাইবজ অফ কার নিকোবর’ স্থান পেয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে।
এই উপজাতি একেবারেই প্রাচীন! এই দ্বীপে এর আগেও ১৮৮০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেতৃত্বে দ্বীপটির বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। সেবার দ্বীপের ৬ জন বাসিন্দাকে তুলে আনা হয়। এর মধ্যে চারজন শিশু। প্রাপ্তবয়স্ক দুজনকে দ্বীপ থেকে আনার পরপরই মারা যায়। বাকি বাসিন্দাদের কিছুদিন রাখার পর কোন তথ্য না পেয়ে তাদের ঐ দ্বীপে রেখে আসা হয়। প্রায় ৬০ বছরের পুরানো এই দ্বীপ বঙ্গপোসাগরের বুকেই অবস্থিত।
আন্দামান নিকোবরের অন্তর্গত এই দ্বীপটির মালিকানা কাগজ কলমে ভারতের হাতে। কিন্তু কারোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না তারা। তারা বস্ত্র হিসেবে এখনো গাছের পাতা বা বাকল অথবা পশুর চামড়া ব্যবহার করে। খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে বনের ফলমূল ও শিকার কৃত পশুর মাংস। তারা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ব্যাবহার করে। অর্থাৎ তাদের কোন কথিত ভাষা নেই। তারা সংখ্যায় কতজন সেই বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে।
সম্প্রতি আন্দামানের সেন্টিনেলিজ়দের তিরের আক্রমণে মার্কিন যুবক জন অ্যালেন চাউয়ের মৃত্যুর খবরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বে। অনেকেই বলেন সেন্টিনেলিজ়দের তাদের মতো ছেড়ে দেওয়াই উচিত। আবার কারও-কারও মতে তারা ‘হিংস্র’, তাই তাদের ‘সভ্য’ করার দায়িত্ব আমাদের!
তারা হয়তো অনেকেই জানেন না যে অ্যালেন চাউয়ের বহু বছর আগেই এই ‘সভ্য’ জগতের একজন সফলভাবে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছিলেন সেন্টিনেলিজ় এবং জারোয়াদের সঙ্গে। তিনি এক বাঙালি কন্যা, মধুমালা চট্টোপাধ্যায়। নিষিদ্ধ দ্বীপের বাঙালি রানী।
আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে The News বাংলা পড়তে লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।