The News বাংলা: মৃত ঘোষণার পরও নাকি রোগীর হাত পা নড়েছে, তাই ডাক্তার এর গাফিলতি বলে তাকে মারো। মাঝে মাঝেই এমন খবরে চমকে উঠি আমরা। কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন, মরার পরেও মৃতদেহের নড়াচড়া খুবই স্বাভাবিক। অবাক হচ্ছেন, জেনে নিন কেন হয় এটা।
আমাদের সহজ ধারণা হল, শ্বাস বা হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল মানেই মৃত্যু হল। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় শুধু তাই নয়। ডাক্তারকে মৃত্যু ঘোষণা করার জন্য কিছু জিনিস দেখে নিতে হয়। যেমন, শ্বাস বন্ধ হল কিনা, হৃৎস্পন্দন বন্ধ হল কিনা, রিফ্লেক্স (সহজ কথায় চাপ তাপ ব্যাথা ইত্যাদিতে মানুষের শরীরের সাড়া দেয়া) ক্ষমতা আছে কিনা, চোখের মনির উপর আলো ফেললে তা সংকুচিত হচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
তার মানে কিন্তু এই নয় যে তখন তার শরীরের সব কোষগুলো মরে গেছে। কিন্তু যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা আর ফেরানো সম্ভব নয় ।
এবার খুব সহজে দুটো জিনিস জেনে নিতে হবে। একটা কে বলা হয় “কার্ডিয়াক ডেথ”। মানে হঠাৎ করে মানুষের হৃৎপিণ্ড তার রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু তখন এমনও হতে পারে যে তার ব্রেন এর সব কাজ বন্ধ হয়নি।
অন্যটা, ব্রেন ডেথ। মানে কোন কিছুতেই সাড়া শব্দ না দেয়া, উদ্দীপনায় সাড়া দিতে ব্যর্থ হওয়া, এবং ভেনটিলেশন ছাড়া শ্বাস নিতে না পারা। এক্ষেত্রে কিন্তু লিগ্যাল ডেথ ঘোষণা করা যায় বা করা হয় । যেমন অঙ্গদান করতে চাইলে এইসময় করা যায়।
এবার মৃত ঘোষণা করার পর কি ঘটে?
প্রথম ঘণ্টাঃ
মাংশপেশী শিথিল হয়ে যায়, চোখ খুলে থাকে, চোখের মনি বড় হয়ে থাকে, মুখ খুলে থাকে, হাত পা এর জয়েন্ট শিথিল হয়ে যায়। চামড়া ঝুলে যায়, মনে হয় যেন হাড়গুলো উঁচু হয়ে আছে। এরপর যেহেতু হৃৎপিণ্ড আর পাম্প করছে না, চামড়ায় রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং চামড়া একটু পাণ্ডুর হতে থাকে।
শরীর ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। নর্মাল ৩৭° সেলসিয়াস থেকে কমতে শুরু করে ও শেষ অব্দি বাইরের তাপমাত্রার সমান হতে চেষ্টা করে। এই তাপমাত্রা কমার একটি নির্দিষ্ট হার আছে, ফরেন্সিক এর লোকজন সেই তথ্য কাজে লাগান কোন মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করার সময়। এই সময়ে শিথিলতার কারণে প্রস্রাব বা পায়খানা হতে পারে। ভুল করেও এসব দেখে ঘাবড়ে যাবেন না।
২ থেকে ৬ ঘণ্টাঃ
যেহেতু হৃৎপিণ্ড আর রক্ত পাম্প করছে না, শরীরের রক্ত তরলের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে শরীরের যে অংশ সবচেয়ে নিচের দিকে থাকে সেখানে জমা হতে থাকে। এবং সেই জায়গার চামড়া লাল হয়ে যেতে পারে। মৃতদেহ না নাড়ানো হলে এটা ভালো বোঝা যায়।
মৃত্যুর মোটামুটি তিন ঘণ্টা পরে (যদিও বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে) আমাদের শরীরের মাংশপেশীগুলো ফের শক্ত হতে শুরু করে। যাকে, রাইগর মরটিস বলা হয়। একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে শরীরের একের পর এক পেশী এভাবে শক্ত হতে থাকে। এবং এই প্রক্রিয়া কোন ভাবেই বন্ধ করা সম্ভব নয়। হাত পা ফের কি করে শক্ত হতে পারে তাই নিয়ে ও ভুল বোঝাবুঝি ও হয়েছে, যা পুরোপুরি ভুল ধারণা।
৭ থেকে ১২ ঘণ্টাঃ
এই সময়ের মধ্যে শরীরের সব মাংশপেশী সবচেয়ে বেশি শক্ত হয়ে যায়। হাঁটু বা কনুই একটু ভাঁজ হয়ে যায়। এই সময় হাত পা নাড়ানো সত্যি খুব কঠিন। যদিও এক একজনের শরীরের অবস্থা বা অন্য কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে শক্ত হওয়া এক রকম না ও হতে পারে।
১২ ঘণ্টার পরঃ
শক্ত হয়ে যাওয়া মাংশপেশী গুলো এই সময়ের পর আস্তে আস্তে আবার শিথিল হতে শুরু করে। তার কারণ কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন। ১ থেকে ৩ দিন অব্দি এই প্রক্রিয়া চলতে পারে। পরিবেশের তাপমাত্রা এটি কে প্রভাবিত করে। চামড়া গুটিয়ে ও শুকিয়ে যায়। অবাক করার মতো বিষয় হল, এই সময় ও চুল এবং নখ বেড়ে গেছে মনে হয়। শরীরের পেশীগুলো যে ক্রম মেনে শক্ত হয়েছিল তার উল্টো ক্রম মেনে শিথিল হতে থাকে।
এবার আসুন সহজে জানার জন্য কতগুলো ঘটনা যা মৃত্যুর পর ঘটেঃ
* হৃৎপিণ্ড বন্ধ হল।
* রক্ত সরবরাহ বন্ধ ।
* পরে থাকা শরীরের নিচের দিকের অংশে চামড়ার রঙ পাল্টে যায় ( যদি না নাড়ানো হয়)।
* নির্দিষ্ট হাড়ে শরীরের তাপমাত্রা কমতে থাকে ( পরিবেশের উপর নির্ভরশীল)।
* শিথিল মাংশপেশী শক্ত/ রাইগর মরটিস হতে শুরু করে
এই সময়ে শরীরের মাংশপেশী তে সংকোচন দেখা যায় (ছোট হয়ে যাবার কারণে), যা দেখে ভুল করে মৃত কে জীবিত বলে মনে হতে পারে।
* আমাদের কপালের ভাঁজগুলো আর দেখতে পাওয়া যায় না।
* চামড়া গুটিয়ে যাবার ফলে চুল ও নখ বাড়ছে মনে হয়।
পায়খানা প্রসাব হতে পারে যা দেখে ভুল করা স্বাভাবিক শরীরে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকেরা মৃত কোষের পচন শুরু করতে সাহায্য করে দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করে।
এই গন্ধে মাছি, পিঁপড়ে , মাকড়সা শকুন রা আকৃষ্ট হয় ।
* শরীরে তৈরি হওয়া গ্যাস ও রাইগর মরটিসের কারণে তার শরীর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ঢেকুর তলা বা গোঙানি বা বিলাপ করার মত আওয়াজ হতে পারে। ভুল ভাববেন না ।
* যেহেতু আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরে , এতদিন যেসব ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে থেকে উপকার ও করতো , তারাই অন্ত্রের পচন শুরু করে দেয়।
* এই গ্যাসের কারণে চোখ ফুলে যাওয়া ও জিভ মুখের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। গ্যাস এতো বেশী হতে পারে যে অনেক সময় মৃতদেহের শরীর ফেটে ও যেতে পারে। ঠিক বেশি গ্যাস ভরা বেলুনের মত।
* শরীরের ভেতরের অংশ পচে গলে তরল হতে শুরু করে।
* শরীরের হাড় ও মাংশপেশী থেকে চামড়া আলাদা হয়ে যায়।
* পচন শুরু হবার পর শরীরের ফ্যাটের একটি বিচিত্র পরিবর্তন হয়, যা মোমের মত কাজ করে ও পচন প্রক্রিয়া কে ধীর করে দেয়
* চামড়া যদিও আলাদা হয়ে যায় চামড়ার কোষগুলো অনেক দিন বেঁচে থাকে।
* খুব গরমের দেশে যেমন মরুভুমিতে বা খুব লবনাক্ত পরিবেশে শরীর শুকিয়ে অনেক সময় মমি হয়ে যেতে পারে। না , পচন হয় না।
হ্যাঁ, মানুষ পচলে সার ও হয় !!! কি অবাক লাগছে? ভালো গাছ ও হয় তাতে!!! আমাদের শরীরের হাড়গুলো সবচেয়ে বেশীদিন অক্ষত থাকে।
বলা যায়, মৃত্যুর পরও মানুষের মৃতদেহ নিয়ে অনেক রকম বিশ্বাস অবিশ্বাস আছে। তার কারণ এগুলোই।