EXCLUSIVE: ‘বৈশাখী প্রেমে ব্যস্ত’ কলকাতা ছাড়ছেন এক সাচ্চা প্রেমিক

2568
The News বাংলা
The News বাংলা

The News বাংলা, কলকাতা: কলকাতা এখন ব্যস্ত শোভনের বৈশাখী প্রেমে। তাঁর কথা কেউ জানেই না। আর এর মাঝেই বৃহস্পতিবার প্রেমের শহর কলকাতা ছাড়ছেন এক সত্যিকারের কলকাতা প্রেমিক।

পি টি নায়ার, পুরো নাম পরমেশ্বরণ থঙ্কপ্পন নায়ার। এখন বয়েস পঁচাশি। ১৯৫৫ সালে বাইশ বছর বয়সে চাকরির খোঁজে মাদ্রাজ মেলে কেরালা থেকে কলকাতা এসেছিলেন বিনা টিকিটে। পকেটে মাত্র কুড়ি টাকা, সঙ্গে ছিল ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট আর শর্টহ্যান্ড ও টাইপিংএর সামান্য জ্ঞান। বর্তমানে কলকাতাকে আপন করে নেওয়া প্রেমিকের কিন্তু তখন এ শহরে কোনও আপনজন ছিল না।

Image Source: Google

কলকাতার ইতিহাস লিখবেন, এমন ভাবনা স্বপ্নেও ছিল না। চাকরি পেলেন ১২৫ টাকা মাইনের টাইপিস্টের। ট্রামে চেপে আর পায়ে হেঁটে ঘুরতে ভালবাসেন, তাই শহরটার গলিঘুঁজিও চেনা শুরু হল। চাকরিসূত্রে মাঝে কয়েক বছরের জন্য শিলঙে থাকতে হয়েছিল, সেই ফাঁকে গ্র্যাজুয়েশনটা করে নেন। ফিরে এসে ভবানীপুরের ৮২/সি কাঁসারিপাড়া রোডের ফ্ল্যাটে সেই যে থিতু হলেন, আর নড়েন নি। দেশ ভুলে আপন করলেন কলকাতাকেই।

আরও পড়ুনঃ কয়েক দশকের সম্পর্ক শেষ করে শোভনকে তাড়ালেন মমতা

পঞ্চাশ বছর কেটে গেল সেখানেই। লেখালিখির শখ ছিল, নানা কাগজে লেখা পাঠাতেন, ছাপাও হত। পুরনো, নজর-কাড়া বাড়ি দেখলেই চেষ্টা করতেন তার সম্বন্ধে জানতে। সাংবাদিকতার চাকরিও করলেন কিছু দিন।

লেখার রসদ পেতেই যাওয়া শুরু হল জাতীয় গ্রন্থাগারে। তাঁর ভবানীপুরের বাসা থেকে হেঁটে মাত্র দশ মিনিট। জাতীয় গ্রন্থাগারে কলকাতার ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে অজস্র বই, নথিপত্র। ঘাঁটতে ঘাঁটতে নায়ারের মনে হল, এত বই লেখা হয়েছে শহরটা নিয়ে কিন্তু অনেক তথ্যই তো সে সবে নেই।

Image Source: Google

কলকাতার ইতিহাস তেমন খুঁটিয়ে বিশেষ কেউ দেখেন নি। সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাগজপত্র, কলকাতায় আসা দেশি বিদেশি অতিথিদের লিখে রাখা বৃত্তান্ত, পুরসভার নথি, এশিয়াটিক সোসাইটির নথি— কত কী ভাল করে দেখার আছে। তা ছাড়া শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটলেই নানা প্রশ্ন জাগে, সে সবের উত্তরই বা কোথায়?

নায়ার ঠিক করে ফেললেন, কলকাতাই হবে তাঁর বাকি জীবনের ধ্যানজ্ঞান। তত দিনে বিয়ে করেছেন, ছেলেমেয়ে হয়েছে। স্ত্রী স্কুলে পড়িয়ে সংসার চালান, ছেলেমেয়ে মানুষ করেন। নায়ার এক বেলা খান, সারা দিন পড়ে থাকেন গ্রন্থাগারে আর নানা নথিখানায়।

আরও পড়ুনঃ প্রেমের জয়ে বদনাম বিশ্ব সংসার ‘অ-শোভন’

সংবাদপত্র থেকে দরকারি খবর কেটে রাখেন সযত্নে। নিয়মিত ঢুঁ মারেন ওয়েলিংটন বা কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানে। তারাও নতুন কিছু পেলে এই কলকাতা পাগলের জন্য রেখে দিত। টুকরো টুকরো করে জড়ো করেন কলকাতার ইতিহাসের খুঁটিনাটি সূত্র। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে মেলামেশায় একদমই আগ্রহী নন। একেবারে কলকাতাচর্চায় নিবেদিত প্রাণ।

কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে লিখেছেন ‘আ হিস্টরি অব ক্যালকাটাজ় স্ট্রিটস’ আর পুরসভার ইতিহাস, এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তিনটি বিশাল খণ্ডে সম্পাদনা করেছেন সোসাইটির উনিশ শতকের প্রথমার্ধের ‘প্রসিডিংস’ আর দু’খণ্ডে ‘ক্যালকাটা টারসেন্টিনারি বিবলিয়োগ্রাফি’।

আরও পড়ুনঃ ‘তাজমহল’ গড়া শেষ না করেই মারা গেলেন ‘শাহজাহান’

সঙ্কলন করেছেন নানা জনের লেখায় সতেরো-আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতার বিবরণ, কলকাতার নামের উৎস, সংবাদপত্র, পুলিশ, হাইকোর্ট, দক্ষিণ ভারতীয় গোষ্ঠী, জাতীয় গ্রন্থাগারের ইতিবৃত্ত, জেমস প্রিন্সেপ আর বিএস কেশবনের জীবনী, এমনকি জব চার্নককে নিয়ে দুর্লভ লেখাগুলি।

তাঁর ঝুলিতে এখন ৬২টি বই, কয়েকটি বাদে সবই কলকাতা সংক্রান্ত। কলকাতায় গাঁধীজিকে নিয়ে ৬৩ সংখ্যক বইটি প্রকাশিত হতে চলেছে। এত বিপুল পরিমাণ কাজের নিরিখে কলকাতা-গবেষক হিসেবে সম্মান, সমালোচনা দুই-ই জুটেছে তাঁর।

আরও পড়ুনঃ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যা ও তারপরের গণহত্যার না জানা সত্যি

সমালোচনার মূল কথা, নায়ার বাংলা পড়তে পারেন না, ফলে কলকাতার ইতিহাসের দিশি উপকরণ তিনি আদৌ দেখেননি। এই কারণে তাঁর বিশ্লেষণে প্রচুর ত্রুটি থেকে গিয়েছে।

নায়ার নিজে মনে করেন, বাংলা না-জানায় তাঁর কোনও সমস্যা হয়নি, ইংরেজি থেকেই তিনি পর্যাপ্ত উপকরণ পেয়েছেন। তবে তাঁর কাছে ‘তথ্য-সংগ্রাহক’ অভিধাটিই যথেষ্ট, এর বেশি কিছু তাঁর প্রত্যাশা নেই।

এ বছর ৩০ এপ্রিল পঁচাশি বছর বয়স পূর্ণ করেছেন পি টি নায়ার। এখনও যান জাতীয় গ্রন্থাগারে। আঠারো বছর আগেই দেশে ফিরে যাওয়া মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু সাধের শহরটা ছাড়তে পারেননি।

Image Source: Google

১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এসে কলকাতাকে ধীরে ধীরে আপন করে নিয়েছিলেন। কলকাতা নিয়ে গবেষণা করতে করতে ৬৩ বছর কলকাতায় কাটিয়ে ৬৩ খানি গ্রন্থের লেখক এখন। বিশ্ববন্দিত এই কলকাতা গবেষক ৬৩ বছর কলকাতায় কাটিয়ে বৃহস্পতিবার ২২ নভেম্বর কলকাতা ছেড়ে চিরদিনের মত চলে যাচ্ছেন কেরালার চন্দমঙ্গলমে।

তার অমূল্য গ্রন্থ সংগ্রহ (প্রায় ছ হাজার) দিয়ে কলকাতা টাউন হলে তৈরি হবার কথা বিশেষ একটি লাইব্রেরি। তবে টাউন হলে সংস্কার এর কাজ হওয়ায় সেই সব বই এখনও বস্তাবন্দী। যে সংগ্রহ ভবিষ্যতে যারা রিসার্চ করবেন, তাদের সম্পদ হবে।

আরও পড়ুনঃ ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ তুমি কার ?

Image : The News বাংলা
Image : The News বাংলা

স্ত্রী এম পি সীতাদেবী এসেছেন কলকাতা-পাগল স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ইতিমধ্যেই বিদায় সৌজন্য জানিয়ে এসেছেন এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সত্যব্রত চক্রবর্তী। এশিয়াটিক রিসার্চ প্রফেসর হিসাবে কাজ করেছেন অনেক বছর। চেনাশোনা অনেকেই আসছেন বিদায় জানাতে।

জিগ্যেস করা হয়েছিল, দেশে ফিরে কি করে সময় কাটাবেন? বললেন ‘নারকেল বাগানে, সেখানে ৭ একর জমিতে আছে সারি সারি নারকেল গাছ’। বিদায় নায়ার। ভালো থাকবেন। কলকাতার নিরানব্বই ভাগ মানুষ হয়ত জানবেই না কে চলে যাচ্ছেন। প্রেমের শহরের অন্যতম সেরা প্রেমিক চলে যাচ্ছেন শহর ছেড়ে।

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন