আজ শুক্রবার ১৮ই মার্চ, খিদিরপুরে ডিসি পোর্ট বিনোদ মেহতা হত্যার ৩৬ বছর পূর্তি। ১৮ ই মার্চ, ১৯৮৩ এর দোল পূর্ণিমার সকাল। হঠাৎ খবর এল গার্ডেনরিচ, খিদিরপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দাঙ্গা লেগেছে৷ খবর পৌঁছাল ডিসি পোর্ট দফতরেও। আর সেটাই হল কাল।
আরও পড়ুনঃ বিজেপি নেতাকে পার্টি অফিসে তুলে নিয়ে পেটাল তৃণমূল নেতাকর্মীরা
মূহুর্তের মধ্যে তৎকালীন ডিসি পোর্ট বিনোদ মেহতা বড় ফোর্স নিয়ে অকুস্থলে পৌঁছে গেলেন। আবার খবর এল খিদিরপুরের পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও দাঙ্গা শুরু হয়েছে। দাঙ্গা ছড়িয়ে পরছে দ্রুত।
কালক্ষেপ না করে বিনোদ কুমার মেহতা, তাঁর দেহরক্ষী মোক্তার আলি এবং পুলিশ ফোর্স অকুস্থলের দিকে রওনা দিলেন৷ এটাই যে তাঁর শেষ অভিযান, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি এই সাহসী ও দক্ষ আইপিএস অফিসার। পোর্ট অঞ্চলে সব দুষ্কর্মের যম হয়ে উঠেছিলেন ডিসি পোর্ট বিনোদ মেহতা।
আরও পড়ুনঃ মমতা কি পাকিস্তানের কণ্ঠ, বিতর্কিত প্রশ্ন নিৰ্মলার
খিদিরপুরের সরু, অপ্রশস্ত গলি ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় বিনোদবাবু এবং তাঁর দেহরক্ষী বুঝতেও পারেননি যে পুরো পুলিশ ফোর্স কোন এক রহস্যময় কারণে ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে। যখন টের পেলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অকুস্হলে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে দুজনকেই চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়৷ পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। একটি বাড়িতে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছিলেন। পারেন নি। পরিণতি এক অসম লড়াই৷ যার ফল প্রথমে মোক্তার আলি ও পরে বিনোদ মেহতাকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়৷
আরও পড়ুনঃ ম্যায় ভি চৌকিদার হু, আমজনতাকে ভোটের স্লোগান জানিয়ে দিলেন মোদী
জানা যায়, বিনোদ মেহতার সাথে একজন Assistant Commissioner of Police ও ছিলেন৷ কিন্তু রহস্যজনভাবে ঐ গলিতে পৌঁছবার আগে তিনি মাথায় ঢিলের বাড়ি লেগে নাকি অসুস্হ হয়ে পড়েছিলেন৷
কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় ডিসি পোর্ট বিনোদ মেহতাকে। একই অবস্থা হয় মোক্তার আলিরও। অনেক পরে দুজনের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ খুঁজে পায় পুলিশ। নৃশংস হত্যাকাণ্ডে চমকে যায় পুলিশ ও আমজনতা।
আরও পড়ুনঃমসজিদে ঢুকে মুসলিমদের গুলি করে হত্যা করা নিয়ে বিস্ফোরক তসলিমা
ময়নাতদন্তে উঠে আসে, নারকীয় অত্যাচার করে খুন করা হয় এই পুলিশ অফিসারকে। বিনোদ মেহতার জননাঙ্গ কেটে নেওয়া হয়েছিল। মৃতদেহের শরীরে কমপক্ষে ২২টি ছুরির আঘাত পাওয়া গিয়েছিল।
পরেরদিনই গ্রেফতার হয় বন্দর এলাকার কুখ্যাত দুষ্কৃতি ইদ্রিশ মিয়াঁ, নান্থা সালেমকে। কিন্তু ইদ্রিশ মিয়াঁর পুলিশ হেফাজতেই মৃত্যু হয়৷ বলা হয়, ডিসি পোর্ট বিনোদ মেহতার মৃতুতে ক্ষুব্ধ হয়ে ইদ্রিশ মিয়াঁকে পিটিয়ে মেরে পুলিশ কর্মীরা।
অবশ্য অভিযোগ ওঠে, আসল নাটের গুরুদের নাম যাতে প্রকাশ্যে না আসে তার জন্যই ইদ্রিশ মিয়াঁকে পুলিশ হেফাজতেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।
আরও পড়ুনঃ ২০২৫ সালের পর ভারতের অংশ হবে পাকিস্তান, ঘোষণা আরএসএস নেতার
এদিকে কেঁচো খুড়তে কেউটে বেরোয়৷ বিভিন্ন অর্ন্ততদন্ত, মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে জানা যায়, বিনোদ মেহতার হত্যাকান্ড কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় বরং সুপরিকল্পিত এক হত্যাকান্ড৷ সেই দুষ্কর্ম সম্পর্কে যাতে বেশী জলঘোলা না হয়, তার জন্য রীতিমতো শলাপরামর্শ করেই পুলিশ হেফাজতে খুন করা হয় ইদ্রিশ মিয়াঁকে৷
আসলে বিনোদ মেহতা পদে এসেই বন্দর এলাকার দুটি কুখ্যাত বাজার যা স্মাগলিং এর জন্য বিখ্যাত(কুখ্যাত?) তাতে হানা দিয়ে কয়েক কোটি টাকার বেআইনি মাল বাজেয়াপ্ত করেছিলেন৷ তাঁর আমলে বন্ধ হয়ে যায় বন্দর এলাকার চোরাচালান।
আরও পড়ুনঃ মোদীর সঙ্গে সবাই চৌকিদার, অদ্ভুত প্রচার বিজেপির
টনক নড়েছিল বন্দর এলাকার বেতাজ বাদশা তৎকালীন দাপুটে নেতা এবং বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার এক সদস্যের। অভিযোগ ওঠে এমনটাই। বিনোদ মেহতাকে সরাবার জন্য টাকা, হুমকি সহ নানা টোপে কাজ না হওয়ায় খুন করার পরিকল্পনা করা হয়। অপরাধ জগৎ এবং রাজনীতির যোগসাজশের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই পুলিশ হেফাজতে ইদ্রিশকে হত্যা করা হয় বলেই অভিযোগ ওঠে।
যথারীতি একটা কমিশনও বসেছিল। কিন্তু প্রসব করেছিল অশ্বডিম্ব। অনেক হারিয়ে যাওয়া কেসের মত আশির দশকের সাড়া ফেলে দেওয়া এই ঘটনাও আজ বিস্মৃতির আড়ালে। অধ্যাপনার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ চাকরি ছেড়ে আইপিএস হয়েছিলেন বিনোদ মেহতা। সাহসী এই পুলিশ অফিসারের দাপট দেখেছিল কলকাতার পোর্ট এরিয়া।
তাই তাঁর মুখ বন্ধ করতে উদ্যোগ নেয় দুষ্কৃতিরা। তবে ৩৬ বছর পরেও সেই দুষ্কৃতীদের ‘মাথা’ আজও অধরা। কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে সোমবার শ্রদ্ধা জানান হয় বিনোদ কুমার মেহতা ও মোক্তার আলিকে। তবে এই ঘটনার পর থেকেই যে বন্দর এলাকায় পুলিশের কোন ক্ষমতাই আর নেই, এমনটাই বলেন আমজনতা।
লেখক: সৈকত বিশ্বাস
আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে The News বাংলা পড়তে লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।