উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতি ও বিভিন্ন জনজাতির কথা, তিনি তাঁর রঙ তুলিতে ফুটিয়ে তুলে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তবে তাঁর কথা এতদিন ভাবেনি সরকার থেকে শুরু করে রাজ্যবাসী। সেই শিল্পী তাঁর শৈল্পিক স্বত্বা প্রায় হারাতে বসেছেন। কিন্তু এমন একটি প্রতিভাকে এভাবে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দিতে নারাজ ছিল তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা। বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীর পর দ্বারস্থ হয়েছিলেন সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। দাবী ছিল, শিল্পীকে দেওয়া হোক ‘বঙ্গরত্ন’ সম্মান। আন্দোলন সফল। শিল্পী পরিতোষ পাল এখন ‘বঙ্গরত্ন’।
আরও পড়তে পারেনঃ রাজ্যের হাতে টাকা নেই বাজারে ধার, তারপরেও বিধায়কদের ভাতা বাড়ছে
শিলিগুড়ির ডাবগ্রামের বাসিন্দা শিল্পী পরিতোষ পাল। যিনি তাঁর জীবনের অর্ধেকটা সময় শুধু ছবি এঁকেই কাটিয়েছেন। তাঁর ছবি পশ্চিমবাংলায় তো বটেই, প্রশংসা পেয়েছে মুম্বাই, ম্যাঙ্গালোর, চেন্নাই সহ সুইজারল্যান্ডেও। তিনি সব সময় তাঁর তুলির ছোয়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতিকে। কোনো আর্ট কলেজে পড়াশুনা না করে, কোনো গুরুর কাছ থেকে তালিম না নিয়েই তিনি নিজের চিন্তা ভাবনাগুলিকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা সম্প্রদায়ের মানুষ। সে সব মানুষের জীবন যাপন, তাদের সংস্কৃতি এসব কিছু দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর ছবির মাধ্যমে। দেশ বিদেশের মানুষ জানতে পেরেছেন কিছু বিলুপ্তপ্রায় জনজাতির কথা। এক কথায় তিনি বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে বাংলার সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর কাজ করেছেন।
আরও পড়তে পারেনঃ পাহাড়ে মোর্চা বিজেপির সঙ্গেই, গোপন আস্তানা থেকে বার্তা বিমল গুরুংয়ের
ত্রীশক্তি অর্থাৎ নারীর শক্তির ওপরই ফোকাস করে ছবি আঁকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। বেহুলা, সাবিত্রি, রতিমায়া তাঁর কাছে ত্রিশক্তি রমনি। শুরু হয় জয় করার পালা। চিত্র শিল্পকর্ম, ভাস্কর্যে একটু একটু করে এগোতে থাকেন তিনি। একটা সময় তাঁর এই শিল্পকর্ম দেশ ছাপিয়ে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রদর্শনী ও গ্যালারিতে স্থান পেতে থাকে।
আরও পড়তে পারেনঃ বিজেপির সমালোচনা করে পাহাড়কে শান্ত থাকার অনুরোধ মুখ্যমন্ত্রীর
তার আঁকা ছবি স্থান পায় দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। ফ্রান্সের ব্রিভ মিউজিয়াম, লন্ডনের নোবেল সেজ, আমেরিকার ফাইন আর্ট গ্যালারী। পাশাপাশি মুম্বাইয়ের সিমরোচা গ্যালারী, চেন্নাইয়ের পালাজো গ্যালারী, দিল্লীর আগষ্ট রেইন গ্যালারী সহ দেশ বিদেশেত তাঁর ছবি স্থান পেতে শুরু করে। সুইডেনে শুধুমাত্র তাঁরই চিত্র ও ভাস্কর্যের ওপর প্রদর্শনী করে সেখানকার এক সংস্থা। বিদেশের মাটিতে প্রসার হয় বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প ও ভাস্কর্যের।
জন্মের পর থেকেই তাঁর একটি কিডনি নেই। এই কিডনি জনিত রোগ ভোগে নুব্জ হয়ে গেলেও ভেঙে পরেন নি কখনই। সেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতেই একটা সময় দক্ষিন ভারতে চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ সময় কাটান। কিন্তু তাঁর জীবনে আরও বিপর্যয় নেমে আসে, দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। ২০০২ সালে তা প্রতিস্থাপন হলেও তাঁকে সবসময় ওষুধ খেতে হয়। প্রতি মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকার ওষুধ খেয়ে তবে তিনি কিছুটা সুস্থ অনুভব করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার সময় শিল্পীর পাশে কেউ দাঁড়ায় নি। সরকার থেকে এতদিন ন্যুনতম সাহায্যও তিনি পান নি।
আরও পড়তে পারেনঃ ব্রিগেড থেকে ফিরেই ভোলবদল, মমতা নয় রাহুলকেই প্রধানমন্ত্রী চাইলেন নেতারা
একটা সময় আলিপুরদুয়ার কলেজে শিক্ষকতা করতেন তিনি, কিন্তু চিকিৎসার জন্য সময় দিতে গিয়ে সেটাও হাতছাড়া হয়ে যায়। এখন দুই মেয়ে, স্ত্রীর ভরণপোষণ ও নিজের ওষুধের খরচ সব কিছুই তিনি গৃহশিক্ষকতা করে উপার্জন করার চেষ্টা করেন। কলা বিভাগের স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের পড়িয়ে তিনি কোন রকমে সংসার চালান। ২০১৪ সালে তিনি ডুয়ার্স-রত্ন সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু এই সম্মান থেকেও তিনি আরও বড় সম্মান পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করেছিলেন তাঁর শিক্ষার্থীরা। সেই সম্মান হল ‘বঙ্গরত্ন’ সম্মান।
আরও পড়তে পারেনঃ বিহারী ভোট ধরতে বাংলায় বাবুলের বিরুদ্ধে বিহারীবাবু
সে কারনে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছিলেন। উত্তরবঙ্গ উৎসবেই যাতে তাদের প্রিয় গুরু তথা মাস্টারমশাই ‘বঙ্গরত্ন’ সম্মান পান তার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। নেতা, মন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও তারা একটি চিঠি পাঠিয়ে আবেদন জানান। তাদের আবেদন ছিল, এমন একজন শিল্পীকে ‘বঙ্গরত্ন’ সম্মানে ভুষিত করা হোক। বিভিন্ন স্কুল কলেজ থেকে তারা সব ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষিকা ও সাধারণ মানুষের সই সংগ্রহ করেন তারা। সেই সাক্ষর সম্বলিত আরও একটি স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয় প্রশাসনের হাতে।
লড়াই সফল। দেশের শিক্ষা সংস্কৃতিকে চিত্র শিল্প ও ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে সুদূর প্রসারের জন্য এবার বঙ্গরত্ন উপাধি পেলেন শিলিগুড়ির পরিতোষ পাল। সোমবার উত্তরবঙ্গ উৎসব মঞ্চে বাংলার আটজন কৃতি সন্তানকে বঙ্গরত্ন উপাধিতে ভুষিত করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। শিল্পী পরিতোষ পাল তাঁর মধ্যে একজন। বাংলার শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি গোটা বিশ্বের দরবারে অন্য আঙ্গিকে তুলে ধরার কারণেই বঙ্গরত্ন উপাধিতে তাঁর নাম নির্বাচিত করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়তে পারেনঃ মার্চেই শুরুতেই ভারতে লোকসভা ভোটের ঘোষণা
পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ থেকে আর আট কৃতি সন্তানকে এই উপাধি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাদের মধ্যে বঙ্গরত্ন পেলেন আলিপুরদূয়ারের শিক্ষাবিদ পরিমল রায়, কোচবিহারের সাংবাদিক সুশান্ত গুহ, দার্জিলিং এর অবসরপ্রাপ্ত মেজর কে পি মাল্লা, উত্তর দিনাজপুরের শিক্ষাবিদ অমিত কুমার সরকার, দক্ষিন দিনাজপুরের ইতিহাসবিদ সুকুমার সরকার, মালদহের ভুমি ব্রান্ডের শিল্পি সৌমিত্র রায়, জলপাইগুড়ির সমাজসেবী অজিত বর্মন ও বিশেষভাবে বঙ্গরত্ন দেওয়া হল সম্প্রতি হেপ্টাথলনে সোনার পদক জয়ী স্বপ্না বর্মনকেও।
আরও পড়তে পারেনঃ মমতার বাছাইয়ে কারা হবেন বাংলার ৪২টি লোকসভা আসনের তৃণমূল প্রার্থী
তবে যেভাবে শিল্পী শিক্ষক পরিতোষ পালের জন্য আন্দোলন করে বঙ্গরত্ন পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম তুলে ধরেন তাঁর প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা, সেটা এককথায় অভূতপূর্ব। তার এই সম্মানের অংশিদার হিসেবে আনন্দিত তার ছাত্র, ছাত্রী সহ গোটা শিলিগুড়ির বাসিন্দারা। আনন্দ খুব স্বাভাবিক। সবার আন্দোলন সফল করে তাদের শিক্ষক শিল্পী পরিতোষ পাল যে এখন ‘বঙ্গরত্ন’।
আরও পড়তে পারেনঃ
শ্রীজাত হেনস্থা ঘটনায় বাংলার বুদ্ধিজীবিদের মুখোশ খুললেন তসলিমা
বাংলায় দুর্গা পুজো বন্ধ করার চক্রান্ত করছে মোদীর বিজেপি, মারাত্মক অভিযোগ মমতার
মোদীর প্রকল্পে আর টাকা দেবেন না মমতা, কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক তলানিতে
একদিনে বহিষ্কৃত দুই তৃণমূল সাংসদ, দিদিকে ছেড়ে মোদীর দলে আর কে কে
ভোটের আগে মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে মোদী সরকারের অন্তর্বর্তী বাজেট
আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে The News বাংলা পড়তে লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।