বাঘের সঙ্গে অভিনয় করাটাই ছিল জীবনের সেরা চ্যালেঞ্জ

7319
Image Source: Google

অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার (জন্মঃ- ২৪ নভেম্বর, ১৯৩১-মৃত্যুঃ- ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭)। ভাবছেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার আবার কে? তিনি আপনার আমার সবার প্রিয় রবি ঘোষ। বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা কমেডিয়ান।

Image Source: Google

বাঘের সঙ্গে অভিনয়ঃ
ট্রেন্‌ড বাঘ। পা ছড়িয়ে ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে শুয়ে। পাশে বসে ভিজে তোয়ালে বুলোতে হবে তার পিঠে। আর মুখে আদর করার ঢঙে বলে যেতে হবে, ‘উম্মা, উম্মা’। সঙ্গের মহিলা ট্রেনারটি বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ বাঘকে বশে আনার এটাই নাকি দস্তুর।

সময়মতো ক্যামেরা চলবে। প্রায় মিনিট দশেক ‘আদর’ চলার মাঝেই বিপত্তি। ‘উম্মা’-র বদলে একবার শুধু ভুলে ‘উমা’ বলে ফেলেছিলেন। তাতেই তেড়েফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাঘটা।

দশ ফুটি তাগড়াই চেহারা। এক থাবায় সাবাড় করে দিতে পারে। করেনি, তবু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রবি ঘোষ বলতেন, মাদ্রাজি ওই বাঘের সঙ্গে অভিনয় করাটাই ছিল জীবনের সেরা চ্যালেঞ্জ! সৌজন্যে সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে।

Image Source: Google

অভিনয়ের জন্য সবঃ
‘হীরক রাজার দেশে’র আউটডোর। ‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা’র গানের সঙ্গে সেই বিখ্যাত শট। গুপী আর বাঘা বাঘের ডেরায় ঢুকবে চাবির খোঁজে। তারই ‘টেক’ নেওয়া চলছিল তখনকার মাদ্রাজে। দূর থেকে ট্রেনার লাঠির ঠক ঠক আওয়াজ করে আবার ‘উম্মা উম্মা’ বলতে তবে সে শান্ত হল।

শ্যুটও হল। শেষমেশ এত কনফিডেন্স পেয়ে গিয়েছিলেন যে স্থিরচিত্রীর আবদারে বাঘকে চুমু খাওয়ার ‘পোজ’-ও দিয়েছিলেন রবি ঘোষ। চ্যালেঞ্জ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এও কম ছিল না। উখরি-তে শ্যুট। শিমলার থেকেও উঁচুতে। বেজায় ঠান্ডা। পাঁচতলা একটা স্লোপিং দেখিয়ে সত্যজিত্‌ রায় তাঁর বাঘা-গুপীকে বললেন, “ওখান থেকে ঝাঁপ দিতে পারবে না তোমরা?”

Image Source: Google

চোখের সামনে স্থানীয় লোকজন তরতর করে উঠে যাচ্ছে। ঝপাঝপ ঝাঁপও দিচ্ছে। দেখেশুনে ওঁরাও এককথায় রাজি। কিন্তু চুড়োয় উঠে হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার জোগাড়! কনকনে হাওয়া। তার ওপর ক্যামেরা গণ্ডগোল পাকালো। ফলে অপেক্ষা দীর্ঘ হল। বেশ খানিক পরে ঝাঁপ দেওয়ার তলব।

এর পর শোনা যাক রবি ঘোষের মুখেই, “দিলাম ঝাঁপ। সে এক এক্সাইটিং ফিলিং। মনে হল পেঁজা তুলোর ওপর দিয়ে গড়িয়ে এলাম। কিন্তু হাত-পা স্টিফ। মানিকদা বললেন, ‘শিগগির ওদের ভ্যানে তোলো। আর গরম দুধ খাওয়াও।’ সব রেডিই ছিল। গাইড বলল, ‘খবরদার আগুনের কাছে যাবেন না। পা ফেটে যাবে। শুধু পা ঠুকুন। হাত পায়ের সাড় ফিরতে লাগল পাক্কা চব্বিশ ঘণ্টা।”

Image Source: Google

কমিক টাইমিংঃ
পরিচালকরা মনে করেন ভারতবর্ষে রবি ঘোষের থেকে বড় কমিক টাইমিং আর কোনও অ্যাক্টরের না কোনও দিন হয়েছে, না কোনও দিন হবে। সূক্ষ্মতার সঙ্গে রবি ঘোষের অভিনয় যারা দেখেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই সেটা স্বীকার করেন। ডিটেলে রবি ঘোষকে অ্যানালাইজ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর অনেক ফিল্মেই রবি ঘোষের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।

রবি ঘোষ বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে তিনি সবচেয়ে পরিচিত তার হাস্যরসাত্মক চরিত্র রূপায়নের জন্য। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে তাকে নিয়মিত অভিনয় করতে দেখা গেছে। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চ এবং টেলিভিশন তথা ছোট পর্দায় দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত গুপী গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্রে বাঘা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন।

The News বাংলা

জন্ম ও কৈশোরঃ
তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। ১৯৪৯ সালে তিনি সাউথ সুবর্ধন মেইন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইন্টারপাস করে তিনি আশুতোষ কলেজ-এ ভর্তি হন, গ্রাজ্যুয়েশনের জন্য।

১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত তিনি বংশাল কোর্টে কাজ করেন। তিনি অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তকে বিয়ে করেন। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর দশ বছর পর তিনি ২৪শে নভেম্বর, ১৯৮২ সালে বৈশাখী দেবীকে বিয়ে করেন।

The News বাংলা

চলচ্চিত্র জীবনঃ
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ‘অঙ্গার’ নাটকে অভিনয় করতে দেখেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ‘আহবান’ চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’তে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সবার নজরে আসেন।

১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় চলচ্চিত্র জগতে একটি মাইলফলক। একে একে তিনি ‘অভিযান’ (১৯৬২), ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০), ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০), ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’ (১৯৯১), ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ (১৯৯৩) সহ বেশকিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

The News বাংলা

তিনি পরিচালনা করেন, নিধি রাম সরদার (১৯৭৬) ও সাধু যুধিষ্ঠীরের কড়চা (১৯৭৪) সিনেমা। তিনি একজন বিখ্যাত থিয়েটার অভিনেতাও বটে। ১৯৭০ সালে তিনি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালেও অংশ নেন। তিনি ‘চলাচল’ থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

হাসির রাজা রবি ঘোষ। আবার ফিরে আসুন বাংলা ফিল্ম জগতে। অন্য ভাবে, অন্য রুপে। মানুষের হাসির খুব অভাব। আবার আপনাকেই দরকার টলিউডে।

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন