The News বাংলা: ক্যালেন্ডারের পাতায় আবার ৮ নভেম্বর এসে হাজির। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের ৩ বছরে পা। নোট বাতিলের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি পালন করছে উভয়েই। সরকারের কাছে দিনটি ‘কালোটাকা বিরোধী দিবস’, বিরোধীদের কাছে ‘কালা দিবস’৷ পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন অবধি নোট বাতিল ইস্যু বাতিল হচ্ছে না, এটা পরিস্কার।
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাত ৮টায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা ভারত। টেলিভশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করলেন, যেখানে যত পুরনো পাঁচশ, হাজার টাকার নোট আছে, সে দিন রাত থেকেই সেগুলো অকেজো হয়ে গেল৷ টিভির পর্দা থেকে সেটা যেন, সুনামির মত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ভারতে।
নোট বাতিলের পর নগদের অভাবে ভুগেছে আমজনতা থেকে শিল্প ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কোটি কোটি মানুষ। সমালোচনার তীব্র ঝড় বয়েছে বিরোধী-সহ বিভিন্ন মহলে। মোদীর দাবি ছিল, দেশের স্বার্থে, অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ও জাল নোট বন্ধ করতেই পুরনো বড় নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আরও পড়ুন: ‘মুসলিম’ নাম বদলে ‘রামরাজ্য’ আনতে উদ্যোগী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ছিল, এর ফলে নাকি ধরা পড়বে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা। কারণ সেগুলি আর ব্যাংকে ফিরবে না। নিকেশ হবে যাবতীয় জাল নোট। বন্ধ হবে সীমান্তে সন্ত্রাসের জন্য যাবতীয় অর্থের জোগান। আটকানো যাবে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর উপর পাথর ছোঁড়া। থামানো যাবে মাওবাদী কর্মকাণ্ড।
২ বছর পরেও চারিদিকে নোট বাতিলের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। বাস হোক বা মেট্রো, রাস্তার মোড়ে অথবা পথে-ঘাটে যেখানেই কান পাতবেন আলোচ্য বিষয় একটাই নোট বাতিলের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি।
বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে, এতকিছুর পরে সাধারণ মানুষের হাতে কী এল? হু হু করে বাড়ছে রান্নার গ্যাসের দাম। রোজ বাড়ছে পেট্রল-ডিজেলের দাম। টাকার দাম কমেছে দফায় দফায়। কমছে আমানতে সুদের হার। নোট বাতিলের ধাক্কায় ছোট ব্যবসা ও শিল্পের দশা বেহাল হয়েছে। কাজ খুইয়েছেন বহু মানুষ। ওদিকে কাশ্মীরে বন্ধ হয়নি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, তাদের ফান্ডিং এবং পাথর ছোঁড়াও। প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।
আরও পড়ুন: উপনির্বাচনে হেরে বিধানসভা ও লোকসভার আগে চিন্তায় বিজেপি
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং নোট বাতিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত। ২ বছর পরেও তার ফল ভোগ করছে মানুষ।’
একদিকে বিজেপি ও তার সহযোগী দলগুলি সভা-সমিতি করে কালো টাকার বিরুদ্ধে আম জনতাকে সতর্ক করার উদ্যোগ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা-সহ পথে নেমে মিছিল করার কথাও বলা হয়েছে কর্মী, সমর্থকদের।
অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস-সহ তৃণমূল, সিপিএম, সিপিআই, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, জনতা দল (ইউনাটেড) এবং ডিএমকে-র মতো মোট ১৮টি দল৷ দিনভর বিরোধী জোটের দলগুলি দেশজুড়ে বিক্ষোভ সমাবেশে করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: জম্মু কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের টার্গেট বিজেপি নেতারা
অন্যদিকে, বিবৃতি দিয়ে নোট বাতিলের নানা সুফল তুলে ধরেছে অর্থ মন্ত্রক। তাদের দাবি, দুই বছর আগে ১০০০ ও পুরনো ৫০০ টাকার নোট বাতিলের ফল মিলেছে হাতেনাতে। কমেছে কালো টাকা, জাল নোট। রাশ টানা গিয়েছে অর্থনীতিতে, নগদ লেনদেনের উপরেও।
তারা জানিয়েছে, নোট বাতিলের আগে অর্থনীতিতে মোট হাতবদল হত ১৭ দশমিক ৭৭ লক্ষ কোটি নগদ টাকা। সেখানে এটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ লক্ষ কোটির কম। এছাড়াও করের আওতায় এসেছেন অনেক বেশি ব্যক্তি ও সংস্থা। বেড়েছে ডিজিটাল লেনদেনের সংখ্যা।
নোটবন্দির প্রায় দু’বছর পর এই বছরের আগস্টে গোনা শেষ হয় বাতিল হয়ে যাওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের সংখ্যা। রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া
একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে প্রায় ৯৯.৩ শতাংশ বাতিল হয়ে যাওয়া নোট ব্যাঙ্কে ফেরত এসেছে।
আরও পড়ুন: মায়ের পুজোয় মদ বিক্রিতে রেকর্ড গড়ল মমতার বাংলা
আর.বি.আইয়ের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, নোট বাতিলের সময় ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের ১৫.৪১ লাখ কোটি টাকা বাজারে চলছিল। এর মধ্যে ১৫.৩১ লাখ কোটি টাকা ব্যাঙ্কে ফেরত এসেছে।
আর.বি.আইয়ের দেওয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে নোটবন্দীর কারণে বাজারে জালনোটের দৌরাত্ম্য বেশ কিছুটা কমেছে। ২০১৫-১৬ সালে ৬,৩২,৯২৬ জালনোট উদ্ধার হয়েছিল। ২০১৬-১৭ তে যা ছিল ৭,৬২,০৭২ ও ২০১৭-১৮ তে সেটা এসে দাঁড়িয়েছে ৫,২২,২৮৩ তে। ফলে পরিসংখ্যান বলছে জালনোটের বাড়বাড়ন্ত বেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে নোটবন্দীর ফলে।
আরও পড়ুন: সিবিআই এর নিজেদের ঝামেলা বাংলায় স্বস্তিতে রাখবে তৃণমূলকে
কেন্দ্রের দাবি ছিল, নোট বাতিলের ফলে ব্যাংকে আর ফিরবেই না কয়েক লক্ষ কোটি কালো টাকা৷ অথচ নোটবন্দির সময় বাজারে যতটা নগদ ছিল এবং যতটা এত দিন ফিরে এসেছে এবং আসছে, সেই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, আখেরে তাদের সে দাবি সত্যি হয় নি। ফলে কালো টাকায় রাশ টানা নিয়ে সরকারের বক্তব্যে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে, বর্তমানে ভারতের GDP গ্রোথ ও আর্থিক দিক থেকে উন্নয়নের জন্যেও বিশেষজ্ঞরা নোটবন্দি ও GST নীতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন। তবে নোটবন্দির ফলে আশা সুফলকে বিরোধীরা এড়িয়ে চললেও প্রত্যক্ষভাবে যে প্রভাব এসেছে তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন: সনাতন হিন্দু ধর্মকে ছোট করার চেষ্টা সফল হবে না
অর্থ মন্ত্রকের দাবি, নোটবন্দির ফলে কয়েক লক্ষ নতুন ট্যাক্সপেয়ার বেড়েছে। ট্যাক্স জমার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। যার জন্য মূলত ভারতের আর্থিক গতিতে বৃদ্ধি হয়েছে।
সব মিলিয়ে ২ বছর পরেও তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রে সেই নোটবন্দী। নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ২ বছর পরেও গোটা ভারতের আলোচনার বিষয়।