কলকাতা: রাজ্যের আবগারি দফতরের হিসেব বলছে, পুজোর মাসে রাজ্য সরকার ১২৭৫ কোটি টাকার মদ বিক্রি করে নতুন রেকর্ড গড়েছে। আবগারি দফতর তৈরি হওয়ার পর কোনও এক মাসে এত রাজস্ব নাকি আগে কখনও আসেনি। শিল্পবিহীন বাংলায় মদই এখন সরকারের রোজগারের সবচেয়ে বড় রাস্তা।
শুরুটা হয়েছিল তারাপীঠে। কৌশিকী অমাবস্যায় মদ বিক্রির রেকর্ড হয়। গত ৩১ অগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর ছিল কৌশিকী অমাবস্যা। কৌশিকী অমাবস্যার এক রাতে শুধু তারাপীঠে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকার মদ বিক্রি হয়। তবে আবগারি কর্তাদের আশা ছিল, দুর্গাপুজোর মাসে মদের রাজস্ব হাজার কোটি ছাড়াবে।
কারণ, অক্টোবরে শুধু মাত্র দুর্গাপুজোই ছিল। অতীত অভিজ্ঞতায় আবগারি কর্তারা দেখেছেন, যে বছর একই মাসে দুর্গা এবং কালীপুজো হয়, সেই মাসে রেকর্ড মদ বিক্রি হয়ে থাকে। তবে কর্তাদের যাবতীয় হিসেব-নিকেশ বদলে দিয়ে এক মাসেই ১২৭৫ কোটির টাকা মদ বিক্রিতে রীতিমতো চমকে গিয়েছেন ‘মদ’ কর্তারা।
আরও পড়ুনঃ অজানা কাহিনির আড়ালে সিদ্ধপিঠ তারাপীঠের তারা মা
রাজ্যের আবগারি দফতর সূত্রে খবর, সরকার মদের পাইকারি ব্যবসা হাতে নেওয়ার পর রাজস্ব বেড়েই চলেছে। কর্পোরেশন তৈরি হওয়ার পর মাসে গড়ে ৯০০ থেকে ৯৫০ কোটি টাকার মদ বিক্রি হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ বেভারেজ কর্পোরেশনকে অনেকেই তাই সরকারের ‘লক্ষ্মীর ঝাঁপি’ বলতে শুরু করেছেন।
আবগারি দফতরের হিসেব বলছে, অক্টোবরে দেশি মদ বিক্রি হয়েছে ১,২৪,১২,২১৭ লিটার। গত বছর পুজোর তুলনায় ৩০.৯৪ শতাংশ বেশি। বিলিতি মদ বিক্রি হয়েছে ১,২০,০২,৬৪৭ লিটার যা গত বছরের তুলনায় ৫৬.৫৬ শতাংশ বেশি। তবে বিয়ারের বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে, বিয়ার বিক্রি হয়েছে ৪৯,৮৮,১৩৮ লিটার!
আরও পড়ুন: তৃণমূলের জেলা কার্যালয়ে তৃণমূল নেতাদেরই শাস্তির দাবীতে পোস্টার
এক কর্তার আক্ষেপ, ‘‘এর মধ্যে ৩ দিন মদের দোকান বন্ধ না থাকলে আর পাঁচ দিন ব্যাঙ্ক বন্ধ না থাকলে হয়তো এ বার ১৫০০ কোটির মদ বিক্রি হয়ে যেত। অবশ্য যা হয়েছে তাও সর্বকালীন রেকর্ড।’’ ২ রা অক্টোবর গান্ধী জয়ন্তী, অষ্টমী ও ঈদের দিন মদের দোকান বন্ধ ছিল।
আবগারি দফতর জানাচ্ছে, রাজ্যে বরাবর দিশি মদের বিক্রিই বেশি হয়। সামগ্রিক মদ খাওয়ার বিচারে দিশি মদ এবারও বেশি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় বিলিতি মদের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৫৭%।
তুলনামূলক ভাবে দিশি মদের বিক্রির হার তেমন মারাত্মক নয়। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাজ্যের মদপ্রেমীরা ক্রমেই বিলিতিতে মজছেন। তবে এ বার পুজোর মাসে বিয়ার বিক্রির হার বেশ কম। কেন? এক আবগারি কর্তার বক্তব্য,‘বিয়ার ছেড়ে অনেকেই হুইস্কি-রাম খাচ্ছেন। তাই বিলিতির বিক্রি প্রচুর বে়ড়েছে। তা ছাড়া বিয়ারের দাম বাড়াও বিক্রি কমার কারণ হতে পারে। এখন গরমও তেমন নেই।’
আরও পড়ুন: নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটে আর পড়াবেন না ‘দেশদ্রোহী’ প্রফেসর
তবে এখানেই শেষ নয়। মা দুর্গার ভক্তদের সঙ্গে এ বার মা কালীর ভক্তদের লড়াই শুরু হয়েছে! আবগারি কর্তাদের আশা, অক্টোবরে পূজার মাসে এসেছে ১২৭৫ কোটি টাকা। নভেম্বরে আছে কালীপূজা, ভাইফোঁটা এবং ছট পুজো। ফলে মদের বাজার চড়াই থাকবে।
এখন শুধু দেখার, মা দুর্গাকে হারিয়ে মা কালীর ভক্তরা নভেম্বর মাসে সরকারকে ১২৭৫ কোটি টাকার বেশি আবগারি রাজস্বের জোগান দিতে পারেন কি না। তাতে নবান্নের ভাঁড়ার উপচে পড়বে। মেলা, খেলা, উৎসবে কোনও ভাটার টান থাকবে না বলেই মত প্রশাসনিক কর্তাদের।
পুজোর মরসুমে মদ বিক্রি থেকে রাজস্ব বাড়াতে জেলার আধিকারিকদের নির্দেশই দিয়েছিল রাজ্য আবগারি দফতর। গত ১ অক্টোবর দফতরের তরফে জেলায় জেলায় আবগারি সুপারদের এই নির্দেশ (মেমো নম্বর ০৪ই/১৩-১৪) দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: ‘মুসলিম’ নাম বদলে ‘রামরাজ্য’ আনতে উদ্যোগী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ
পুজোর মাসের আগে, চলতি আর্থিক বছরে সারা রাজ্যে মদ বিক্রি কিছুটা কম হয়েছিল। তারই জেরে আবগারি খাত থেকে প্রত্যাশা অনুসারে রাজস্ব সংগ্রহ হয়নি। তাই পুজোর সময়ে মদ বিক্রি বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ে জোর দেওয়ার জন্য নিদের্শ দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে অবৈধ মদ বিক্রি বন্ধ করার কথাও বলা হয়েছিল। নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, পুজোর সময়ে জেলার আধিকারিকরা ছুটি পাবেন না।
নভেম্বরেও মদের বাজার চাঙ্গাই থাকবে বলে মত আবগারি দফতরের। তাই কালীপুজোয় ও ভাইফোঁটায় এই নির্দেশ বহাল থাকছে। আবগারি দফতর সূত্রে খবর, গত আর্থিক বছরে রাজ্য সরকার আবগারি খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছিল প্রায় ২৭০০ কোটি টাকা। সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছিল। চলতি আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৩২০০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন: রাহুলের ‘রাফায়েল’ আক্রমণে মোদীর ‘রথ’ গাড্ডায়
দফতরের শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার কাছাকাছি রাজস্ব এসেছিল, যা ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকটাই কম। তবে পুজোর মাসেই সেই লক্ষ্যমাত্রা টপকে গেল রাজ্য।
পুজোতেও প্রতিদিন মদের দোকান খোলা রাখার অনুমতি দেয় রাজ্য সরকার। এত দিন পুজোর সময়ে দু’দিন মদের দোকান বন্ধ রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ বারে সেই নিয়ম শিথিল হয়ে যাওয়ায় মদের কালোবাজারি হয়নি। ক্রেতাদের অতিরিক্ত পয়সা গুনতে হয়নি নেশার জন্য। ফলে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত মদের দোকান থেকে দেদার মদ বিক্রি হয়েছে চারদিনই।
পুজোর প্রথম দিন থেকেই অসুরের ভূমিকায় নামে বৃষ্টি। যার ফলে বহু মানুষই ঘরবন্দি থেকেছেন। আর তাতেও নাকি মদের বিক্রি বেড়েছে। আপাততঃ শিল্পবিহীন রাজ্যে ‘মদশিল্প’ এর জয়জয়কার।