রাজনৈতিক লড়াই চলছে। একে অপরকে ছেড়ে কথা বলছেন না। তবে, এবার একটা বিষয়ে বেশ মিল পাওয়া গেল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। আর সেটাও খাবার বিষয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর চপ-তেলেভাজা শিল্প ও প্রধানমন্ত্রীর পকোড়া শিল্প হাসির খোরাক জুগিয়েছে সাধারণ মানুষকে।
২০১৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী নবান্নে ‘তেলভাজা শিল্পে’র কথা বলে রাজ্যজুড়ে হাসির খোরাক হয়েছিলেন মমতা। ২০১৮ সালের ১৯ শে জানুয়ারী ‘পকোড়া শিল্পে’র কথা বলে সেই হাসির খোরাকে নিজের অংশগ্রহণ পাকা করেছিলেন মোদী৷ আর সোমবার রাজ্যসভায় প্রথমবার ভাষণ দিতে গিয়ে ফের প্রধানমন্ত্রী মোদীর পকোড়া শিল্প তত্ত্বকে সামনে আনলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। দু্ঃখের বিষয় এটাই যে তেলেভাজা বা পকোড়া, কোনটাই কিন্তু কর্মসংস্থান নয়। আর কতদিন সাধারণ মানুষকে টুপি পড়াবেন মমতা, মোদী ও অমিত শাহের মত নেতারা? উঠছে প্রশ্ন৷
দেশের পাশাপাশি রাজ্যেও বাড়ছে বেকার সমস্যা। প্রতি বছরই ইউনাইটেড নেশনস ইন্টারন্যাশানাল লেবার অরগানাইজেশন বা ILO বের করে World Employment and Social Outlook নামে একটি রিপোর্ট৷ এবারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালের শেষে ভারতে বেকারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১৮ মিলিয়ান বা এক কোটি আশি লক্ষ৷ লেবার ওরগানাইজেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশজুড়ে বেকার বেড়েছে প্রায় ১ লক্ষ৷ ২০১৮ তে বাড়বে আরও ২ লক্ষ৷
ভারত সরকারের লেবার ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট বলছে, প্রতি হাজার জনে ভারতে গড়ে ৫০ জন কর্মহীন। এই হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ১০০০ জনে ৪৯ জন কর্মহীন। তবে, এটা পুরোপুরি সরকারী রিপোর্ট। সরকারী রিপোর্টেই যদি ১৩০ কোটি জনগণের দেশে ৬ কোটি ৫০ লাখ কর্মহীন দেখায়, তাহলে আসল সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটাই প্রশ্ন।
তাহলে কি সরকারী রিপোর্টে তেলেভাজা আর পকোড়া বিক্রেতাদেরও কর্মহীনদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এই প্রশ্নের উত্তর প্রায় পরিস্কার। রাজ্যে চপ তেলেভাজা বিক্রেতা আর দেশে পকোড়া বিক্রেতাদেরও যে কর্মসংস্থানের তালিকাতেই স্থান দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা তা একেবারে পরিস্কার৷
তেলেভাজা ও পকোড়া তৈরী করে জীবনধারণ করাটা কি সত্যি কর্মসংস্থান বলে মনে করেন রাজনীতিবিদরা ? প্রশ্ন উঠেছে, সরকারী কর্মসংস্থানের হিসাবে চপ-তেলেভাজা-পকোড়া ভেজে বা অন্যের বাড়িতে কাজ করে বা ট্রেণে হকারি করে রোজগার করাটাও কি কর্মসংস্থানের মধ্যে পরে?
কি বলছেন অর্থনীতিবিদরা? তাঁরা বলছেন, কৃষি, শিল্প ও সার্ভিস ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানকে রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার কর্মসংস্থান বলে দেখাতে পারে৷ কিন্তু, কখনই চপ ভাজা বা পকোড়া ভেজে জীবনধারণ করাকে নয়৷ অর্থনীতিবিদ দেবাশীস সরকার বলছেন, রাজ্য বা দেশে শিল্প ক্ষেত্রে একধরণের মন্দা চলছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। তাই রাজনৈতিক নেতারা হতাশা থেকেই চপ তেলেভাজা শিল্প বা পকোড়া শিল্পের কথা বলছেন।
ঠিক একই ধরণের অবস্থা বাংলায় তথা ভারতে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাতেও নতুন শিল্প নেই, সরকারী কোষাগারের অবস্থা খুব খারাপ। সরকারী চাকরীর সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্তঃ কম। শিল্প না থাকায় শিল্পে বিনিয়োগও কম। সরকারের বিনিয়োগ করার ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। ফলে বাড়ছে বেকার সমস্যা। আর মুখ্যমন্ত্রীর মুখে চপ-তেলেভাজা শিল্পের কথা।
দেশের দিক থেকে দেখলেও সেই একই অবস্থা। নতুন শিল্প নেই, শিল্পে বিনিয়োগ নেই। ১৩০ কোটির দেশে সরকারী চাকরীও অত্যন্তঃ কম। ফলে বাড়ছে বেকার সমস্যা। হতাশা থেকেই পকোড়া শিল্পের মত এই ধরণের অযৌক্তিক মন্তব্য করছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসক দলের সর্বভারতীয় নেতারা।
অর্থনীতিবিদ দেবাশীস সরকার বলছেন, ‘এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশনের বিষয়টা সম্পূর্ণ হবে দেশের মূল অর্থনৈতিক কারবারের বিকাশের মাধ্যমে৷ কৃষি, শিল্প ও সার্ভিস সেকটরের বিকাশের মাধ্যমেই কর্মসংস্থানের বিষয়টা নির্ভর করে৷’ তাঁর মতে, শিল্পের ক্ষেত্রে মন্দা দেখা দেওয়ায় সরকার বিনিয়োগ করতে পারছে না, কর্মসংস্থানও হচ্ছে না৷ তিনি পরিস্কার জানিয়েছেন, চপ তেলেভাজা পকোড়ার মাধ্যমে দেশ বা রাজ্যের বিকাশ হয় না৷ তাঁর মতে, একটা চরম হতাশা থেকেই রাজনৈতিক নেতারা এই ধরণের অযৌক্তিক কর্মসংস্থানের মন্তব্য করছেন৷
ফলে কখনও নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কখনও বা রাজ্যসভায় শাসকদলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের কন্ঠে সেই হতাশার ছায়া। আর তাই চপ শিল্প, তেলেভাজা শিল্প বা পকোড়া শিল্পের অবতারণা। তবে মাই ডিয়ার রাজনৈতিক নেতারা, এর কোনটাই শিল্প নয়। চপ, তেলেভাজা ও পকোড়া শিল্পের নামে সাধারণ মানুষকে হাস্যরস দেওয়া যাবে, বোকা বানানো যাবে কি? প্রশ্ন কিন্তু উঠছে।