The News বাংলা: ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪। ভারতের ইতিহাসের কালো দিন। ওইদিন সকাল ৯টা ২০মিনিটে তাঁর নয়াদিল্লির সফদর জং রোডের বাসভবনে, তাঁকে গুলি করে হত্যা করে তাঁরই দুজন শিখ দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের দুবারের প্রধানমন্ত্রী। দুই শিখ দেহরক্ষীর ৩০টি বুলেট তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। শুধুমাত্র কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ক্ষতে প্রলাপ দিতে পারবে না।
আরও পড়ুনঃ শিক্ষিতদের বিধায়ক করল তেলাঙ্গানা, কবে শিখবে বাংলা
১৯৮৪ সালে জুনের প্রথম দিকে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দিরে চালান হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে এক সামরিক অভিযান। এই অভিযানে স্বর্ণমন্দিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। বলা হয়ে থাকে, সেই অভিযান ইন্দিরা সরকারের প্রতি শিখসমাজকে ব্যাপকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সেই সূত্রেই সৃষ্ট ক্ষোভের জের হিসেবেই ইন্দিরা গান্ধী খুন তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে।
![](https://www.thenewsbangla.com/wp-content/uploads/2018/10/The-News-Bangla-Indira-9.jpg)
ইন্দিরা গান্ধীর পুরো নাম, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী নেহরু। জন্ম ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। খুন হন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বে। তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। আবার প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৮০ সালে। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর খুন হওয়ার আগে পর্যন্ত। তিনিই ভারতের একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী।
আরও পড়ুন: রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ মিশন ছেড়ে বিপ্লবী হন এই নারী
১৯৫৯ সালে নির্বাচিত হন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। তাঁকে তাঁর বাবার উত্তরাধিকারি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধী তখন তা গ্রহণে অস্বীকার করে বরং ক্যাবিনেট মিনিস্টার হওয়াটাকে বেছে নেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর উত্তরাধিকারী হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।
আরও পড়ুনঃ ‘ইন্দিরা গান্ধী ভারতে এমারজেন্সি লাগু করেছিলেন, বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী পরিচিত হয়ে ওঠেন তার অভাবনীয়ভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার কঠোর মনোভাবের জন্য। তাঁর সিদ্ধান্তেই পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে ভারত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। এ যুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। এর ফলে উপমহাদেশে ও ভারতে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়।
![](https://www.thenewsbangla.com/wp-content/uploads/2018/10/The-News-Bangla-Indira-3.jpg)
১৯৮৪র ৩১শে অক্টোবর ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য যাওয়ার পথে সকাল ৯টা ২০মিনিটে তিনি খুন হন। এই ব্রিটিশ অভিনেতা আইরিশ টেলিভিশনের জন্য একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছিলেন। ১ নম্বর আকবর রোডের অফিসের কাছের ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাসভবনে বাগানের একটি পথ দিয়ে তখন ইন্দিরা হাঁটছিলেন। তিনি যখন সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিংহের প্রহরাধীনে ‘উইকেট গেট’ (বিশেষ কোনো বড় দরজার পাশে বা ভেতরে থাকা ছোট দরজা) দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখন এরা তাঁর ওপর গুলি ছোড়ে।
আরও পড়ুনঃ নেতাদের গুন্ডা পোষা না গুন্ডাদের নেতা হওয়া, প্রকাশ্যে বন্দুকবাজির কারন কি
সাব-ইনস্পেক্টর বেয়ান্ত সিং তার সাইড আর্ম থেকে তিনটি গুলি ছোড়ে ইন্দিরার তলপেটে। এরপর তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সতওয়ান্ত সিং তার স্টেনগান থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। গুলি করার পর উভয়ই তাদের অস্ত্র হাত থেকে ছুড়ে ফেলে। তখন বেয়ন্ত সিং বলে, ‘যা করার ছিল, আমি তা করে ফেলেছি, তুমি যা করতে চাও করো’।
পরবর্তী ৬ মিনিটের মধ্যে ইন্ডো-তিব্বতান বর্ডার পুলিশের রমেশ সিং জামওয়াল ও রাম শরণ, ইন্দিরার খুনি বেয়ান্ত সিংকে ধরে একটি আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। অভিযোগ, বেয়ান্ত সিং এক অফিসারের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। অপরদিকে ইন্দিরা গান্ধীর অন্যান্য দেহরক্ষীরা সতওয়ান্ত সিংকে গ্রেফতার করে। আদালতের রায়ে সতওয়ান্ত সিংকে তার সঙ্গী কেহার সিং সহ ১৯৮৯ সালের ৬ই জানুয়ারী ফাঁসি দেওয়া হয় দিল্লির তিহার জেলে।
আরও পড়ুনঃ মঙ্গলবার হাইকোর্টের দুই বিচারপতির ঘরে বাংলায় ‘গেরুয়া রথ’ এর ভবিষ্যৎ
অভিযোগ আছে, ইন্দিরা গান্ধীর সেক্রেটারি আর কে দেওয়ানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরার পাহারা থেকে শিখ সদস্যদের সরিয়ে দিতে। আর কে দেওয়ান তা উপেক্ষা করেন। উল্লেখ্য, বেয়ান্ত সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর খুবই প্রিয় দেহরক্ষী। তাকে তিনি চিনতেন ১০ বছর ধরে। ঘটনার সময় অন্য খুনি সতওয়ান্ত সিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস আগে তাকে ইন্দিরার দেহরক্ষী নিয়োগ করা হয়।
![](https://www.thenewsbangla.com/wp-content/uploads/2018/10/The-News-Bangla-Indira-10.jpg)
১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দূরদর্শনে সন্ধ্যার খবরে ইন্দিরা হত্যার খবর প্রচার করা হয়। এই খবর প্রচারিত হয় তাকে গুলি করার ১০ ঘণ্টা পর। সকাল সাড়ে ৯টায় তাকে ভর্তি করা হয় অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে। সেখানে তার অপারেশন চলে। বেলা ২টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুনঃ শহীদ জওয়ানকে সম্মান নয়, সেনাকে পাথর ছুঁড়ে দেশদ্রোহীরাই ভারতে ‘নায়ক’
এরপর চলে ময়নাতদন্ত। কমপক্ষে ৩০টি বুলেট বিদ্ধ হয় ইন্দিরার শরীরে। বুলেট ছোড়া হয় স্টেনগান ও পিস্তল থেকে। খুনিদের ছোঁড়া ৩০টি গুলির মধ্যে ২৩টি গুলি শরীরের এক পাশে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ৭টি গুলি দেহের ভেতরেই থেকে যায়।
আরও পড়ুনঃ বাংলায় ২৫ টাকা কেজি পেঁয়াজ, নাসিকে দাম না পেয়ে আত্মহত্যা
১৯৮৪র ১নভেম্বর তাঁর মৃতদেহ একটি গানবহরে করে দিল্লির রাস্তা দিয়ে নিয়ে রাখা হয় তিনমূর্তি ভবনে। মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধ রাজঘাটের কাছের শক্তিস্থলে তার শেষকৃত্য হয় ৩নভেম্বর। তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেলিভিশন ও বিবিসি সহ অন্যান্য রেডিওতেও।
![](https://www.thenewsbangla.com/wp-content/uploads/2018/10/The-News-Bangla-Indira-8.jpg)
তাকে দাহ করার পর শুরু হয় ভয়ানক শিখবিরোধী দাঙ্গা। এতে প্রায় তিন হাজার শিখ প্রাণ হারায়। বাস্তুচ্যুত হয় আরও কয়েক লাখ শিখ। ইন্দিরার মৃত্যুর পর শিখবিরোধী দাঙ্গা চলায় শিখবিরোধী জনতা ও কংগ্রেস সমর্থকরা। শিখ ধর্মাবলম্বী দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করার পর, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এই দাঙ্গা বাধে।
এক সরকারি হিসেবেই এই দাঙ্গায় আট হাজারের মতো শিখ নিহত হয়। শুধু দিল্লিতেই নিহত হয় তিন হাজার। দাঙ্গা চলে ৩১অক্টোবর থেকে ৩নভেম্বর পর্যন্ত। দফায় দফায় চলে এ দাঙ্গা। এই দাঙ্গাতেই শিখ হত্যাকারী হিসাবে অভিযুক্ত হিসাবে নাম উঠে আসে কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমার সহ অন্যান্যদের।
![](https://www.thenewsbangla.com/wp-content/uploads/2018/10/The-News-Bangla-Indira-4.jpg)
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-র(সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন) রিপোর্টে বলা হয়, ‘দিল্লি পুলিশের চুপ থাকার কারণেই এই দাঙ্গা আরও ছড়িয়ে পড়ে’। কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু আমলা ও কমকর্তাও এ কাজে সহায়তা জোগায়। মায়ের মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী হন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি বলেছিলেন ‘বড় গাছ যখন পড়ে, তখন মাটি কাঁপে’।
![](https://www.thenewsbangla.com/wp-content/uploads/2018/10/The-News-Bangla-Indira-6.jpg)
এই দাঙ্গায় সরকারি রিপোর্ট মতে, শুধু দিল্লিতেই ২ হাজার ৭০০ জন নিহত হয়। দাঙ্গার পর ভারত সরকারের রিপোর্টে বলা হয়, দিল্লি থেকে ২০ হাজার লোক বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবে বেসরকারি মতে, এই সংখ্যা কমপক্ষে এক লক্ষ। এই দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি শিকার হয় দিল্লির শিখ অধ্যুষিত এলাকা।
আরও পড়ুনঃ প্রেতচর্চা ও বিখ্যাত বাঙালি
সারা ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিশ্বাস এই হত্যাযজ্ঞ ছিল সংগঠিত। এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্তাদের অবস্থান সাধারণ শিখদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। বেড়ে যায় খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন। ‘অকাল তখত’ নামের শিখবাদের ধর্মীয় গভর্নিং বডি এই হত্যাকাণ্ডকে জেনোসাইড বা গণহত্যা বলে মনে করে।
![](https://www.thenewsbangla.com/wp-content/uploads/2018/10/The-News-Bangla-Indira-7.jpg)
২০১১ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভারত সরকারকে জানায়, এখনও এই ‘মাস কিলিং’ এর বিচার হয় নি। ২০১১ সালে উইকিলিকস কেবল লিকস জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার এই দুষ্কর্মে সহযোগিতা জুগিয়েছিল।
পড়ুন হাড় হিম করা অদ্ভুত সত্য গল্প
পড়ুন প্রথম পর্বঃ পৃথিবী এগোলেও তান্ত্রিকের কালো জাদু টোনায় ডুবে আফ্রিকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই কাজকে অভিহিত করে ভারত সরকারের শিখবিরোধী ‘অপরচুনিজম’ ও ‘হ্যাট্রিড’ নামে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দাঙ্গাকে গণহত্যা বলতে অস্বীকার করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলে এটি ছিল ‘ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন’। কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে প্রলাপ দিতে পারবে না।