‘কম্যান্ডো’৷ একটা শব্দই ঝাঁকিয়ে দেয় সাধারণ মানুষকেও৷ যে কোন সাধারণ সেনাবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালি, অনেক বেশি ক্ষিপ্র, চোখের পলক ফেলার আগেই শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পরতে সদা প্রস্তুত ভারতের এই কম্যান্ডোরা। বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় ভারতের ৯টি কম্যান্ডো বাহিনী যেন অধিক হিংস্র, ক্ষিপ্র ও গতিসম্পন্ন।
প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় এরা খুব বেশি পারদর্শী। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শত্রুর সামনে সাক্ষাৎ যম হয়ে উদয় হয়ে শত্রু বিনাশ করতে এদের জুড়ি মেলা ভার। বিপদ মোকাবিলায় এরা এতটাই ভয়ানক যে এই ৯ বাহিনীকে বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর কম্যান্ডো বাহিনী হিসাবে গণ্য করা হয়।
পড়ুন দ্বিতীয় পর্বঃ শত্রুকে নিমেষে নিকেশ করে ভারতের সেরা ৯ কম্যান্ডো বাহিনী
পড়ুন তৃতীয় পর্বঃ শত্রুকে নিমেষে নিকেশ করে ভারতের সেরা ৯ কম্যান্ডো বাহিনী
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, ভারতের এই ৯ কম্যান্ডো বাহিনীকে। প্রথম পর্বে ৩ কম্যান্ডো বাহিনী সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিন।
১. Marine Commandos বা মার্কোসঃ মার্কোস, ভারতীয় নৌসেনা বাহিনীর কম্যান্ডো। ভারতের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কম্যান্ডো বাহিনী। বিশ্বের সেরা ১০ কম্যান্ডো বাহিনীর মধ্যে এর স্থান ৭ এ। নৌসেনার কম্যান্ডো হলেও জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে শত্রুর মোকাবিলায় ওস্তাদ এরা। এমনকি, গভীর জলের নীচেও এরা সমান তালে লড়াই করতে সক্ষম।
আমেরিকান নেভি সিলের মত ১৯৮৭ সালে এই কম্যান্ডো বাহিনী তৈরি হয়। তারপর থেকে একের পর অসম্ভব অপারেশন করে দক্ষতায় সকলকে চমকে দিয়েছে এরা। শত্রুপক্ষ এদের ‘দাড়িওয়ালা ফৌজ’ বলেও ডাকে। জলে ‘মগরমাছ’ বা কুমীরের ক্ষিপ্রতায় শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পরে এরা। নৌসেনার সেরা অফিসারদের মার্কোস বাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য পরীক্ষা হয়। মার্কোসের অন্তর্ভূক্তির পরীক্ষা মারাত্মক ও কঠোর।
মার্কোসের সদস্য হওয়ার জন্য যে শারীরিক পরীক্ষা দিতে হয়, তাকে ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হয়। জওয়ানদের প্রথমে শারীরিক সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। যারা এই পরীক্ষায় পাশ করে, তারপর তাদের ৫ সপ্তাহের একটি ভয়ঙ্কর ট্রেণিং এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যাকে বলা হয়, ‘হেলস উইক’ বা ‘নরকের সপ্তাহ’৷
যেখানে না ঘুমিয়ে কঠোর শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা দিতে হয় জওয়ানদের। যেখানে তাদের শুয়ে বসে, দাঁড়িয়ে, দৌড়াতে দৌড়াতে, সামনে পিছনে গুলি ছোঁড়ার ট্রেণিং দেওয়া হয়। এমনকি কাঁচে ছবি দেখেও গুলি চালাতে শিখতে হয়। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে গুলি চালানো শিখতে হয়।
ফাইন্যাল ট্রেণিং এ ৮০০ মিটার হাঁটু ডোবা কাদা রাস্তায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে যেতে গুলি চালানো শিখতে হয়। যেটাকে বলা হয় মৃত্যুর হামাগুড়ি। ২ বছরের মারাত্মক ট্রেণিং এর শেষে তবেই মার্কোস বাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয় একজন জওয়ানকে।
মার্কোস কম্যান্ডোরা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করে। এই কম্যান্ডোদের হাতে থাকে ব্রাউনিং হাই পাওয়ার ৯mm পিস্তল, গ্লক ১৭ ৯mm সেমি অটোমেটিক পিস্তল, ইসরায়েলে তৈরি টাভোরটার ২১ অ্যাসল্ট রাইফেল সহ বিশ্বের ৩৭টি উন্নত অস্ত্র। যেহেতু জলে থেকে লড়াই করে মার্কোস, তাই তাদের সমস্ত অস্ত্র ওয়াটারপ্রুফ। জলের তলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকলেও এদের অস্ত্রের কিছু হয় না।
হেলিকপ্টার, সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ সহ যে কোন জায়গা থেকেই অ্যাটাক করতে পারে মার্কোস। মার্কোস বাহিনীর কম্যান্ডোদের আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে আমেরিকান নেভি সিল ও ব্রিটিশ স্পোশাল ফোর্সের সঙ্গে ট্রেণিং হয়। অপারেশন পবন, অপারেশন ক্যাকটাস, অপারেশন লীচ, অপারেশন তাশা, অপারেশন সাওন সহ বিভিন্ন অপারেশনে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে মার্কোস। অবাস্তবকে বাস্তবে ও অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করার আর এক নাম মার্কোস।
২. গরুড় কম্যান্ডোঃ রামায়ণে কথিত আছে, সীতাহরণের সময় রাবণ এর মত প্রবল প্রতাপশালি যোদ্ধাকে প্রচন্ড লড়াইয়ের মুখে ফেলেছিলেন গরুড়। পুরাণে উল্লিখিত গরুড়ের নামেই এই কম্যান্ডো বাহিনীর নাম। ভারতীয় বায়ুসেনার অধীনে এই কম্যান্ডো বাহিনী। ‘আক্রমণই হলো বাঁচার মন্ত্র’, এই আদর্শেই অনুপ্রাণিত গরুড় কম্যান্ডো বাহিনী। বায়ুসেনার যে কোন আক্রমণে সামনের সারিতে থাকে এই কম্যান্ডো বাহিনী।
২০০১ সালে জম্মু কাশ্মীরে বায়ুসেনার দুটি বিমানঘাটিতে পরপর জঙ্গী আক্রমণ হয়। ২০০৪ সালে এইসব হামলা প্রাথমিক পর্যায়ে ঠেকাতেই বায়ুসেনার নিজস্ব এই কম্যান্ডো বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। এদের প্রশিক্ষণ এতটাই কঠিন যে, একজন বায়ুসেনা জওয়ানের পুরোপুরি গরুড় কম্যান্ডো হতে অন্তত ৩ বছর সময় লাগে। গরুড়ের মতই আকাশ থেকে আচমকা নেমে এসে শত্রু নিধন করে এই কম্যান্ডো বাহিনী।
অ্যান্টিহাইজ্যাকিং থেকে শুরু করে প্যারাট্রুপিং, এমনকি বরফের মধ্যেও লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় গরুড় কম্যান্ডোদের। নৌসেনার কমান্ডো বাহিনী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর অ্যান্টিইনসার্জেন্সি এবং জঙ্গল ওয়ার-ফেয়ার স্কুলেও গরুড় কম্যান্ডোদের প্রশিক্ষণ দেয়ানো হয়। পাঠানকোট বায়ু সেনা ঘাটিতে জঙ্গিদের খতম করতে নামানো হয়েছিল গরুড় কম্যান্ডোদের।
৩. ঘাতক কম্যান্ডোঃ ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর কম্যান্ডো এরা। ২০ সদস্যের এই কম্যান্ডো বাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্যই হলো সঠিক নিশানায়, চোখের পলকে হামলা করা এবং শত্রুপক্ষকে হতভম্ব করে দেওয়া। মূল বাহিনীর সাহায্য ছাড়াই যাতে এরা অভিযান চালাতে পারে, সেভাবে প্রশিক্ষিত করা হয় এদের। দুর্গম পাহাড়ের গা বেয়ে যে কোনো উচ্চতায় উঠে যেতে পারে ঘাতক কম্যান্ডো বাহিনী।
১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে এই কম্যান্ডো বাহিনীকে নামানো হয়েছিল। এদের হাতেও টেভরটার ২১, ইনসাস রাইফেল, একে ৫৬ জাতীয় রাইফেল থাকে৷ সঙ্গে থাকে স্নাইপার রাইফেল। সঙ্গে থাকে ছোট পিস্তলও। মূল সেনাবাহিনীর আক্রমণের আগেই বাহিনীর ঘাতক কম্যান্ডোদের হাতে ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যায় শত্রু বাহিনী।
এঁরা রকেট লঞ্চার, গ্রেনেড লঞ্চার নিয়েও আক্রমণ করেন সীমান্ত শত্রুদের। গ্রেনেডিয়ার যোগেন্দ্র সিং যাদব ছিলেন একজন ঘাতক কম্যান্ডো যিনি ১৮ গ্রেনেডিয়ারের সদস্য ছিলেন। কার্গিল যুদ্ধে টাইগার হিল দখলের সময় তাঁর ঘাতক বাহিনীই আগে ঝাঁপিয়ে পরেছিল টাইগার হিলের শত্রুদের উপর। তিনি পরমবীর চক্রও পান।