The News বাংলা, নিউ দিল্লিঃ আন্দামানের নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে নিখোঁজ দুই মৎস্যজীবীর মৃতদেহ উদ্ধারে গিয়ে আদিবাসীদের তীরের মুখে পড়েছিলেন কমান্ড্যান্ট প্রবীর গৌড় ও তাঁর সঙ্গীরা। কমান্ড্যান্ট প্রবীর গৌড় গোটা ভারতকে বলেছিলেন সেই রোমহর্ষক ঘটনা।
‘আমার চপারের দিকে উড়ে আসছিল তীর’, কমান্ড্যান্ট প্রবীর গৌড়। ‘একটার পর একটা উড়ে আসছিল তীর। সঙ্গে ধারালো বর্শা, লাঠি মুর্হুমুর্হু। চপারের পাখা সবে ঘুরতে শুরু করেছে। মাটি ছাড়তে আর মিনিট খানেক দেরি। দূর থেকে দুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসছে এক ঝাঁক কালো মাথা। রোগা, কালো শরীরগুলো থেকে প্রতিহিংসার আগুন যেন ঠিকরে বেরচ্ছে’। উত্তর সেন্টিনেলে দুই হারিয়ে যাওয়া মৎস্যজীবীর খোঁজ করতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতারই মুখোমুখি হয়েছিলেন কমান্ড্যান্ট প্রবীন গৌড়।
সালটা ২০০৬। আন্দামানের নর্থ সেন্টিনেলের কাছাকাছি মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ দুই মৎস্যজীবী। পুলিশের অনুমান, সম্ভবত তাঁরা মৃত। কারণ ২০০৪ সালে সুনামির পর ত্রাণ বিলি করতে গিয়েই সেন্টিনেলিজদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল পুলিশ ও উপকূল রক্ষী বাহিনীকে। তারপর থেকে ওই দ্বীপের ত্রিসীমানায় পা রাখা নিষিদ্ধ। মৎস্যজীবীদের দেহ খুঁজে বার করার দায়িত্ব পড়েছে কোস্ট গার্ড অফিসার প্রবীনের উপর। সঙ্গে জনাকয়েক রক্ষী নিয়ে তিনি উড়ে গেছেন আন্দামানের উত্তর সেন্টিনেলে।
‘আতঙ্কের সে প্রহর ছিল বড়ই ভীষণ’। কমান্ড্যান্ট বললেন,’আমাদের চপার চক্কর কাটছে দ্বীপের চারদিকে। উত্তর ও দক্ষিণ সেন্টিনেল আঁতিপাতি করে খুঁজে আমরা থিতু হলাম উত্তর সেন্টিনেলের সৈকত ঘেঁষে। নীচ দিয়ে উড়ছে চপার। হঠাৎই চিৎকার। দেখলাম ছুটে আসছে একদল আদিবাসী। প্রত্যেকের হাতে তীর-ধনুক, ধারালো অস্ত্র।’
আরও পড়ুন: ধর্মান্তরকরণের উদ্দেশ্যে এসে আদিবাসীদের হাতে নিহত মার্কিন খ্রীষ্টান মিশনারী
চপার দেখেই তীর ছুড়তে শুরু করেছিল আদিবাসীরা। প্রবীন জানিয়েছেন, সেই দলে কোনও মহিলা ছিল না। প্রায় জনা পঞ্চাশ পুরুষ, হাতে যা ছিল চপারের দিকে ছুঁড়ে মারছিল।
আদিবাসীদের নিশানা সাঙ্ঘাতিক। প্রতিটা তীর উড়ে আসছিল প্রায় ১০০ ফুট উচ্চতায়। বেগতিক দেখে চপার উড়িয়ে আদিবাসীদের নাগালের বাইরে চলে গেছিলেন তাঁরা। ‘প্ল্যান এ’ মুখ থুবড়ে পড়ার পর ‘প্ল্যান বি’ তাঁরা ঠিক করে ফেলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে আকাশেই চক্কর কেটে ফের ফিরে আসেন দ্বীপের কাছাকাছি।
সৈকতের এক জায়গায় দুটো বড় বালির ঢিবি কমান্ড্যান্ট ও তাঁর সঙ্গীরা দেখেছিলেন আগেই। সম্ভবত সেই ঢিবি দুটোই ছিল মৃত মৎস্যজীবীদের কবর। কারণ সেন্টিনেলিজদের প্রবতা হল শিকারের পর সেটাকে বালির নীচে চাপা দিয়ে রাখা। ঢিবি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বে চপার নিয়ে নজর রাখা শুরু করেন তাঁরা। আদিবাসীরা তখন ধারে কাছে নেই। চটপট পরিকল্পনা স্থির করে চপার নিয়ে প্রবীন এগিয়ে চললেন ঢিবির দিকে।
আরও পড়ুন: ভারতীয় সিনেমার জনক দাদাসাহেব ফালকে না হীরালাল সেন?
পাশাপাশি দুটো বড় বালির ঢিবি। মধ্যেকার দূরত্ব দুই ফুট হবে। ‘দ্রুত চপার থেকে নেমে আমরা বালি খোঁড়া শুরু করি। কিছুটা খুঁড়তেই একটা দেহ বার হয়। পাশেরটা থেকে বার হয় আরও একটা দেহ। দুটো দেহ নিয়ে যখন উড়ব ভাবছি আচমকাই দেখি সেন্টিনেলিজদের যোদ্ধারা ছুটে আসছে’।
এরপরের ঘটনা আরও ভয়ানক, বললেন প্রবীন, ‘একটা দেহ নিয়ে কোনও মতে চপারে উঠতেই দেখি সেন্টিনেলিজরা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদল চপার লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে যাচ্ছে, অন্যদল বালিতে পড়ে থাকা আরও একটা দেহ ঘিরে রেখেছে। অতএব একটা দেহ নিয়েই আমরা দ্বীপ ছেড়ে বেরিয়ে আসি।’
আরও পড়ুন: ‘শব্দের জন্য’ ট্র্যাজিক জীবন ভারতীয় সিনেমার জনকের
যে কোনও মুহূর্তে তীরের ঘায়ে ধরাশায়ী হতে পারতেন তাঁদের মধ্যে যে কেউ, এমনটাই জানিয়েছেন প্রবীন। তাঁর কথায়, দুই মৎস্যজীবীকে তাদেরই বোটের দড়ি দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরেছিল সেন্টিনেলিজরা। পরে সেই দেহ তারা পুঁতে দেয় বালিতে। উদ্ধার করা একটি দেহ তুলে দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের হাতে।
এই দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য ওই বছরের স্বাধীনতা দিবসের দিন কোস্ট গার্ড কমান্ড্যান্ট প্রবীন গৌড়কে পুরষ্কৃত করে সরকার। মার্কিন পর্যটক জন অ্যালেন চাওয়ের মর্মান্তিক পরিণতির কথা শুনেই নিজের সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা সংবাদমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন প্রবীন।
কমান্ড্যান্ট প্রবীন গৌড় বলেছেন,’নিষিদ্ধ দ্বীপে অভিযানের প্রতিটা মুহূর্ত ছিল রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় ভরপুর। মৃত্যুর হাতছানি ছিল প্রতি পদে পদেই। সভ্য মানুষদের প্রতি এক সীমাহীন বিতৃষ্ণা ও রাগ এখনও পোষণ করে চলেছে উপজাতিরা।’