সোনালী চুলের রাজপুত্রের জেল। মাথায় একরাশ সোনালী চুল; বয়স মাত্র ১৭। সেই কিশোর কিনা বড়বড় খেলোয়াড়দের চিৎপাত করে; জিতে নিলেন পুরুষদের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন ট্রফি! ভাবা যায়? ১০৮ বছরের ঐতিহ্যশালী টুর্নামেন্টে; যা কোনদিন হয়নি। ফ্লুক? সেটা যে নয়, পরের বছর আবার জিতে; সেটাও প্রমাণ করে দিলেন। বয়স তখন মাত্র ১৮; যে বয়সে জুনিয়ার উইম্বলডন খেলে অন্যান্যরা।
সেই সোনালী চুলের যুবকের টেনিস কোর্টে দাপাদাপি দেখতে; কি ভালই না লাগত। যেন স্বপ্নের রাজপুত্র; নেমে এসেছে বাস্তবের মাটিতে। নামও দেওয়া হল; ‘সোনালী চুলের রাজপুত্র’। আরও নাম, বরিস ‘বুমবুম’ বেকার। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা নাম জুড়ল; স্টেফি গ্রাফ। সোনালী চুলের রাজকন্যা; হৃদয়ের রানী। আসলে দুজনেই জার্মানির; টেনিস ফুটবল মিশে একাকার। মা-বাবার বকুনি উপেক্ষা করে; বাড়ির দেওয়ালে বরিস বেকার ও স্টেফি গ্রাফ। আমাদের ভালবাসার ছেলেবেলা, ছোটবেলা।
আর বড়বেলায় দেখলাম; বিশ্বের একনম্বর টেনিস প্লেয়ার নোভাক জকোভিচের কোচ হিসাবে। সেখানেও সাফল্য। বরিসের হাতে পড়ে; একের পর এক সাফল্য পেল জকোভিচ। বেকারের কোচিং জমানায়; সাত-সাতটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন নোভাক। আর বুড়োবেলায় সোনালী চুলের সেই রাজপুত্রকে জেলে যেতে হল; জালিয়াতির অভিযোগে। টেনিস ইতিহাসের অত্যন্ত জনপ্রিয় তারকা বরিস বেকার এর বিরুদ্ধে; উঠেছিল জালিয়াতির অভিযোগ। আর সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই; এবার আড়াই বছরের জেল হল এই টেনিস কিংবদন্তির।
৫৪ বছর বসয়ী বরিসকে ঋণ পরিশোধ করার জন্য; সম্পত্তি গোপন ও কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এর আগে বরিস নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছিলেন ২০১৭ সালে। শুক্রবার দেউলিয়া আইনের অধীনে; চারটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বরিস।
পুরো ঘটনাটা কী? ২০১৭ সালে স্পেনের শহর মায়োরকায়; সম্পত্তি কিনেছিলেন বেকার। ব্যাঙ্ক থেকে তিন মিলিয়ন পাউন্ড ঋণ নিয়ে। সেই ঋণ তো জার্মান টেনিস কিংবদন্তি ফেরত দেনইনি; উল্টে ধার যাতে শোধ করতে না হয়, তাঁর জন্য নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে দেন। কিন্তু আদালতে প্রমাণ হয়ে গেল যে; ২০১৭ সালের পর নিজের প্রাক্তন স্ত্রী বারবারার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে; অকাতরে পাউন্ড ট্রান্সফার করতেন বেকার। খবর যা, প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ পাউন্ড; প্রাক্তন স্ত্রী সহ ন-জনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভাগাভাগি করে পাঠিয়েছিলেন বেকার। পরবর্তীকালে বর্তমান স্ত্রী লিলির অ্যাকাউন্টেও; একই জিনিস করতেন তিনি।
শুধু তাই নয়, জার্মানিতে নিজের আরও একটি সম্পত্তির কথা; ঘোষণা করেননি বেকার। আট লক্ষ পঁচিশ হাজার ইউরোর ব্যাঙ্ক লোন নেওয়ার কথাও; গোপন করে গিয়েছেন। মাঝে বিশাল অঙ্কে নিজের একটা মার্সিডিজ বেচে দিয়েছিলেন; সেটাও বলেননি। এক বিলাসবহুল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে; হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করতেন। বিখ্যাত ডিজাইনার রাল্ফ লরেনের পোশাক পরে; ঘুরে বেড়াতেন। নিজেকে ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করে! তদন্তে প্রমাণ হয়ে যায়; তিনি সঠিক তথ্য দেননি।
শুধু তাই নয়, ১৯৮৫, ১৯৮৬ ও ১৯৮৯ সালের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন ট্রফি; ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ট্রফি; ১৯৮৯ সালের ইউএস ওপেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ট্রফি; এবং ১৯৯২ সালে অলিম্পিকে জেতা ডাবলস সোনার পদকের কথা জানাননি তিনি। হ্যাঁ, ওই ৬টি গ্র্যান্ড স্লামই জিতেছিলেন বরিস। শুধু তাই নয়, নিজের বিলাসবহুল মার্সিডিজ বিক্রি করে পাওয়া; ১.১৩ মিলিয়ন ইউরো লুকিয়েছিলেন। জার্মানিতে থাকা তাঁর দুটো সম্পত্তির পাশাপাশি; প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ ইউরোর ব্যাঙ্ক লোনও লুকিয়েছিলেন প্রাক্তন টেনিস তারকা।
লন্ডনের সাউথওয়ার্ক ক্রাউন আদালতে, বরিসের মামলার বিচারক ডেবোরা টেলর জানান; “বরিস এই ঘটনার জন্য কোনও অনুশোচনা দেখাননি। শুধু তাই নয়; তিনি নিজের অপরাধ স্বীকারও করেননি। এই মাসের শুরুর দিকে, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সাক্ষ্য শোনার পর; বিচারকগণ বেকারকে সম্পত্তি লুকিয়ে রাখার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন। এবং সম্পত্তির পুরো খতিয়ান প্রকাশ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ও ঋণ গোপন করার জন্য; তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আড়াই বছর কারাগারের অন্ধকারে কাটাতে হবে; আমাদের ছোটবেলার সোনালী চুলের রাজপুত্রকে।
বেকারের উদ্দেশে বিচারক বলেন; ‘আপনাকে সতর্ক করা সত্ত্বেও আপনি পাত্তা দেননি। তার জন্যেই আপনাকে এই শাস্তি দিতে হচ্ছে; খ্যাতির চূড়া থেকে মাটিতে নামতে হল আপনাকে। আপনার টেনিসজীবন, জনপ্রিয়তা সব কিছু হারালেন; নিজেকে মিথ্যে দেউলিয়া ঘোষণা করার কারণে’।
অথচ কী পাননি বরিস বেকার এই জীবনে? ছ-ছটা গ্র্যান্ড স্ল্যামের অধীশ্বর তিনি; অলিম্পিকে সোনা। টেনিসের সর্বকালের অন্যতম সেরা প্লেয়ার হিসেবে তাঁকে ধরা হয়। আর আজ? আজ তিনি আকাশ থেকে পাতালে; একাধিক অপরাধে। রাতারাতি কিংবদন্তি থেকে জালিয়াত; স্বপ্নের এক রাজপুত্রের কী মর্মান্তিক পরিণতি! ছোটবেলার স্বপ্নের কারিগররা, আমাদের বারবার বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে আছড়ে ফেলে।
লিখলেন; মানব গুহ