ভোট প্রচারে বিরোধীদের রুখতে এবার আকাশেও কব্জা বিজেপির। ভোটের সময়ে অধিকাংশ প্রাইভেট জেট এবং হেলিকপ্টারই এখন তাদের দখলে। তাতে চেপে সকাল-বিকাল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন দলের নেতারা। তাতেই বিপাকে পড়েছে অন্য বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে কংগ্রেস। প্রত্যন্ত এলাকায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে চাইলেও, বিমান ও কপ্টারের অভাবে তা হয়ে উঠছে না বলেই অভিযোগ। আকাশ দখলে মোদী-অমিত শাহ এর কাছে পাত্তা করতে পারছেন না রাহুল।
এবারের ভোট মরশুমে অধিকাংশ প্রাইভেট জেট ব্যবহারের জন্য আগাম ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন হেভিওয়েটরা। যার মধ্যে বেশিরভাগ ভাড়া করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির নেতাদের প্রচারের জন্য। সূত্রের খবর, প্রাইভেট জেট এবং কপ্টার মিলিয়ে প্রায় ৫০টি আকাশযান ভাড়া নিয়ে রেখেছে বিজেপি। আর কংগ্রেস সেখানে টেনেটুনে মাত্র ১০টি প্রাইভেট জেট নিজেদের জন্য পেয়েছে। অর্থাৎ এখানেও এক অসম লড়াই।
শোনা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহর প্রচারের জন্য প্রস্তুত রাখা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি প্রাইভেট জেট। বাকিগুলি অন্যান্য হেভিওয়েট নেতাদের জন্য। অমিত শাহ দিনে সবচেয়ে বেশি সফর করছেন। দিল্লি থেকে সেই কোন দক্ষিণে বিজয়ওয়াড়া যাচ্ছেন, আবার সেখান থেকে যাচ্ছেন উত্তর-পূর্বের ডিব্রুগড়ে। অসম থেকে আবার একই দিনে ফিরে যাচ্ছেন নিজের বাড়ি, আমেদাবাদে। এভাবেই কপ্টারে চড়ে দিনভর তিনি দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন।
আরও পড়ুনঃ নরেন্দ্র মোদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের হুঁশিয়ারি দিলেন কংগ্রেস নেতা
লোকসভা নির্বাচনের দিন ক্ষণ ঘোষণার তিনমাস আগে থেকেই বিজেপির তরফে বেসরকারি বিমান ও হেলিকপ্টারের বুকিং শুরু করে দেওয়া বলে জানিয়েছেন মার্টিন কনসাল্টিং সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা তথা ভারতের বিজনেস এয়ারক্র্যাফ্ট অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মার্ক মার্টিন। তাঁর কথায়, ‘লোকসভা নির্বাচনে প্রতিপক্ষের প্রচারে বিঘ্ন ঘটানো নতুন কিছু নয়। কিন্তু রাজনীতির ময়দান ছাড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আকাশে গিয়ে পৌঁছতে দেখা যায়নি আগে কখনও। প্রতিপক্ষকে রুখতে আকাশের দখল নিয়েছে একটি দল। এমন গেরিলা যুদ্ধ আগে কখনও দেখা যায়নি’।
লোকসভা ভোটে প্রচারের জন্য এত হেলিকপ্টার বুকিংয়ের হিড়িক দেখে আশ্চর্য হয়েছেন বাণিজ্যিক উড়ান সংস্থার উচ্চস্তরের আধিকারিকরাও। মার্ক মার্টিন নামে উড়ান সংস্থার পরামর্শদাতা বলছেন, ‘আগেও লোকসভা ভোট দেখেছি। কিন্তু রাজনীতির লড়াই আকাশে এতদূর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে, আগে দেখিনি। মনে হচ্ছে, সবাই যেন গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর আরকে বালির কথায়, ‘আগে এলে, আগে পাবেন–এই নিয়ম মেনে আমরা বুকিং নিয়েছি।
এ বছর লোকসভা নির্বাচনে ভোটদাতার সংখ্যা ৯০ কোটি। দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকাতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন ভোটদাতারা। তাঁদের কাছে পৌঁছতে রেল বা সড়কপথকে ভরসা করছেন না নেতারা। ভোট ঘোষণার ঢের আগে থেকেই তাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বিজেপি। নির্বাচনী প্রচারের জন্য এ বারে কমপক্ষে ২০টি প্রাইভেট জেট ও ৩০টি হেলিকপ্টার আগাম বুক করেছে তারা। তাতেই বিপাকে পড়েছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। বিজেপির দখলে থাকা বিমান বহরের মাত্র এক পঞ্চমাংশ তাদের হাতে এসেছে বলে গোপন সূত্রে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুনঃ হারবেন বুঝেই নির্বাচন কমিশনকে টার্গেট মমতার, কটাক্ষ অমিতের
সাধারণত ৪৫ দিনের জন্য প্রাইভেট জেট বুক করতে গেলে প্রতি ঘণ্টায় ৫ হাজার ৭০০ ডলার খরচ হয়, ভারতীয় মুদ্রায় যা ৩ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা। হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় দিতে হয় ৭ হাজার ২০০ ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় তা ৫ লক্ষ টাকার বেশি। তাই এ বারের নির্বাচনী প্রচারে বিজেপির তরফে কোটি কোটি টাকা ঢালা হচ্ছে বলে জল্পনা রাজনৈতিক মহলে।
কারণ নির্বাচনের ঘোষণা হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিমান নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন বিজেপি নেতারা, যাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি তথা এ বারে গাঁধীনগরে দলের প্রার্থী অমিত শাহ। গত ৬ এপ্রিল সকালে প্রথম নয়াদিল্লি থেকে দেশের দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়া ছুটে যান তিনি। সেখান থেকে আবার রওনা দেন পূর্বের ডিব্রুগড়। সন্ধ্যায় আবার ফিরে যান পশ্চিমের আমদাবাদ। অর্থাৎ ওই একদিনেই প্রায় ৪ হাজার ৫০০ মাইল (৭ হাজার ২৪২ কিলোমিটার) পথ পাড়ি দেন তিনি।
আরও পড়ুনঃ মুকুলের হাত ধরে তৃণমূল ছেড়ে কি বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন মমতার দুই বিধায়ক
বিজনেস এয়ারক্র্যাফ্ট অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আরকে বালি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে কোনও সংযোগ নেই বিমান সংস্থাগুলির। বরং নির্বাচনের সময় লোকসান পুষিয়ে নেওয়াই লক্ষ্য থাকে। তাই ব্যবসাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়”। তবে রাজনৈতিক দলগুলি সরাসরি বিমানের বুকিং করে না বলেও জানান বালি। তিনি জানান, এ ক্ষেত্রে চার্টার দালালদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে কথা বলে ঘণ্টা প্রতি দাম ঠিক করে তারা। তাতে নিজেদের লাভের অংশ যোগ করে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে বিক্রি করে।
তবে বিরোধী দলগুলির তুলনায় বিজেপির বিমান সংখ্যা বেশি হওয়া নিয়ে সাফাই দিয়েছেন দলের কর্মী গুলাব সিংহ পানওয়ার। গত ২২ বছর ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত তিনি। এ বছর দলের জন্য পাঁচটি বিমান বুক করেছেন। কংগ্রেসে প্রচারে বাধা সৃষ্টি করার অভিযোগ উড়িয়ে তিনি বলেন, “বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। তাই বেশি সংখ্যক বিমানের প্রয়োজন পড়েছে। এ ব্যাপারে কোথাও কোনও ভুল নেই”।
আরও পড়ুনঃ ভোটের মধ্যেই চরম লজ্জা, চৌকিদার চোর বলায় ক্ষমা চাইতে হল রাহুল গান্ধীকে
যদিও জানুয়ারি মাসেই উল্টো অভিযোগ করেছিলেন কংগ্রেস মুখপাত্র আনন্দ শর্মা। প্রাইভেট কপ্টার পেতে তাঁদের নাকাল হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এর আগে ২০১৪-র নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর প্রচার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল কংগ্রেস। বিমানের ভাড়া কে জুগিয়েছিল, তা জানতে চেয়েছিল তারা। সেবার শিল্পপতি গৌতম আদানির বিমান নিয়েই মোদী এদিক-ওদিক ছুটে গিয়েছিলেন বলে সামনে এসেছিল। তবে বিনা পয়সায় কাউকে বিমান দেন না বলে পরে জানিয়েছিলেন আদানি।
বিজেপি কর্মী গুলাব সিং পানওয়ার, যিনি নেতানেত্রীদের প্রচার কর্মসূচিতে কপ্টারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছেন, তিনি জানাচ্ছেন, ‘বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে হেলিকপ্টার, জেট একটু বেশিই দরকার পড়ছে৷ আমরা চার্টার্ড বিমানই বেশি পছন্দ করি। কারণ, এটা খুব মজবুত আর নিরাপদ’।
আরও পড়ুনঃ পুলিশের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করলেন বাবুল সুপ্রিয়
আর হাতশিবির সূত্রে খবর, দুঁদে কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মা নাকি সেই জানুয়ারি মাস থেকেই হেলিকপ্টার বুকিংয়ের জন্য চেষ্টা করে চলেছেন। তবে তেমন একটা সুবিধে করতে পারেননি। নইলে কি আর কংগ্রেসের ভাগ্যে মোটে ১০টি কপ্টার জোটে? কিন্তু যাই বলুন না কেন, জিততে মরিয়া বিজেপি যে কোটি কোটি টাকা ছড়িয়ে বিরোধীদের প্রচারকে বানচাল করে দেওয়ার খেলায় মেতে উঠেছে, সেটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে The News বাংলা পড়তে লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।