জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে ‘নেহেরুর বউ’

1655
জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে 'নেহেরুর বউ'/The News বাংলা
জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে 'নেহেরুর বউ'/The News বাংলা

যাবজ্জীবনও আগে ১২ বছরের হত। তারপর অপরাধীকে ক্ষমা করা হত। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতেন অপরাধী। তবে তাঁকে দীর্ঘ ৬০ বছর পরেও কেউ ক্ষমা করে নি। অপরাধ, সাঁওতাল মেয়ে হয়ে ‘বাইরের একটা লোকে’র গলায় মালা দেওয়া। আর সেই ‘বাইরের লোকটা’ হলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। আর সেই অপরাধে, আজও একঘরে হয়ে বেঁচে ‘নেহেরুর বউ’।

আরও পড়ুনঃ জয় হিন্দ, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের সোনার অক্ষরে লেখা ইতিহাস

১৯৫৯-এর ৬ ডিসেম্বর, সুইচ টিপে তিনি উদ্বোধন করেন দামোদর নদীর উপর পা়ঞ্চেত বাঁধ। যা ছিল স্বাধীন ভারতের নবজাগরণের একটা ঐতিহাসিক অধ্যায়। ৬০ বছর আগে তাঁর হাতেই উদ্বোধন হয়েছিল পাঞ্চেত বাঁধের। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সে দিন পা়ঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন করেন সাঁওতালি রমণী বুধনী ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।

জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে 'নেহেরুর বউ'/The News বাংলা
জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে ‘নেহেরুর বউ’/The News বাংলা

বাঁধের কাজ শুরু হতে কাজের সুযোগ পেয়েছিল পুরুলিয়া ঝাড়খন্ড সীমান্তে চারপাশের গ্রামের বেশ কিছু আদিবাসী নারী-পুরুষ। উদ্বোধনের দিন নেহরুকে দেখার জন্য তারাও হাজির ছিল সে দিন। কিন্তু, নেহরুর গলায় মালা পরিয়ে স্বাগত জানাবে কে?

আরও পড়ুনঃ ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায়

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের কর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দায়িত্ব পড়ল রাবণ মাঝির পনের বছরের সাঁওতাল মেয়ে ‘সুন্দরী’ বুধনির উপর। পাঞ্চেত ড্যামের উপর নেহেরুর গলায় মালা পরিয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন বুধনি। নেহরু খুব খুশি। নিজে নন, বাঁধ উদ্বোধন করালেন বুধনিকে দিয়ে। বুধনির হাতেই উদ্বোধন হল পা়ঞ্চেত বাঁধের। উদ্বোধনী বক্তৃতায় নেহরু বললেন, “এই বাঁধই হল টেম্পল অব ডেভেলপিং ইন্ডিয়া”।

জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে 'নেহেরুর বউ'/The News বাংলা
জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে ‘নেহেরুর বউ’/The News বাংলা

খুলে গেল দেশের উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত। আর সেই সঙ্গে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল বুধনীর জীবনের সব দিগন্তই। সাঁওতালি কুমারী মেয়ে কিনা মালা পরাল সমাজের বাইরের এক সাদা চামড়ার লোকের গলায়! এত বড় অপরাধ! বুধনীর আদিবাসী সমাজ তাঁকে ত্যাগ করল। একঘরে করা হল তাঁকে। অপরাধ, ‘প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দেওয়া’।

আরও পড়ুনঃ কালামের নামে ছাত্রদের তৈরি হালকা উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়ে নজির ভারতের

এক ঐতিহাসিক দিনে চিরতরে পালটে গেল বুধনির জীবন। উদ্বোধনের অনুষ্ঠান শেষে বুধনি বাড়ি ফিরছিল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার রেশ নিয়ে। যে প্রাপ্তি তার কাছে আশাতীত ছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল। বাড়ি ঢোকার আগেই গ্রামের মোড়লরা তাকে ‘তলব’ করল।

জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে 'নেহেরুর বউ'/The News বাংলা
জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে ‘নেহেরুর বউ’/The News বাংলা

কেন? তার বিচার হবে। বুধনি বুঝে উঠতে পারছিল না, সে কী অপরাধ করেছে! মোড়লদের মতে, তার অপরাধ, সে পরপুরুষের গলায় মালা পরিয়েছে! সে অবিবাহিত। তাদের আদিবাসী সমাজের নিয়ম অনুযায়ী অবিবাহিত মেয়ে কোনও পুরুষের গলায় মালা পরালে ধরে নেওয়া হয় তারা বিয়ে করল। সে দিক থেকে দেখলে বুধনি তখন নেহরুর স্ত্রী!

আরও পড়ুনঃ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আগে কোন কোন বাঙালি ভারতরত্ন হয়েছেন

কিন্তু নেহরু তো আর সাঁওতাল নন। তাছারা তিনি ঘরেও তুলবেন না বুধনিকে। তাই ‘বেজাতে’ বিয়ে করার অপরাধে একঘরে করে দেওয়া হয় বুধনিকে। বহিষ্কৃত করা হয় সমাজ থেকে। তার মুখ দেখবে না সমাজের কেউই। বুধনির নামই হয়ে গেল ‘নেহেরুর বউ’।

জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে 'নেহেরুর বউ'/The News বাংলা
জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে ‘নেহেরুর বউ’/The News বাংলা

১৯৫৯ থেকে ২০১৯। সেই ঘটনার পর কেটে গিয়েছে দীর্ঘ ৬০টা বছর। দামোদর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভারতের ৬০ বছরের ইতিহাস। পাঞ্চেত বাঁধ পেরিয়ে তাঁর বাড়ির পথের সন্ধান করতে গিয়ে আজও অবাক হতে হয়। অটোচালক, দোকানদার, রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষ, প্রায় সকলেই বুধনির বাড়ির পথ চেনেন। বুধনির কথা উঠতেই তাঁদের মধ্যে অনেকেরই প্রশ্ন, “আপনি কি খবরের লোক না সিনেমার লোক”?

আরও পড়ুনঃ জন্মদিনে নেতাজি সুভাষের মৃত্যুদিন নিয়ে ছেলেখেলা রাহুলের কংগ্রেসের

হঠাৎ এই প্রশ্ন? তারাই জানালেন, “খবরের লোকেরা আগে আসত মাঝে মাঝে। চার বছর আগে মুম্বই থেকে একজন সিনেমার পরিচালক বুধনির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি তাঁর বায়োপিক করতে চান। অনেক টাকা অফার করা হয়েছিল বুধনিকে। কিন্তু টাকার অঙ্ক মোটা হলেও বুধনি রাজি হয়নি”। কেন? সে উত্তর অবশ্য তাঁদের জানা নেই।

জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে 'নেহেরুর বউ'/The News বাংলা
জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে ‘নেহেরুর বউ’/The News বাংলা

পরপুরুষের গলায় মালা পরালে বিয়ে হয়ে যায়, সে কথা জানতেন না? বুধনি বললেন, “সাহেব সুবারা বলেছিল। আমি কী করব! তখন তো আমি ছোট, আমার মাথায় কি বুদ্ধি ছিল? বুদ্ধি থাকলে কি এমন কাজ করতাম? যাদের ছিল তারা তো সব পিছিয়ে গেল”। নেহরু কিছু বলেননি আপনাকে? “কী বলবে ও! শুধু বলেছিল, বেটি, তোমার জীবনভর চাকরি রইল”। অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আর দিতে চান না বুধনি। আর পিছন ফিরে তাকাতে চান না।

বুধনি এখনও দামোদর ভ্যালি করপোরেশনের কর্মী। যদিও জীবনভর চাকরি থাকার আশ্বাস পাওয়ার পরও কর্মক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল তাঁকে। শোনা যায়, বুধনিকে সমাজ ত্যাগ করার পর তিনি সুধীর দত্ত নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় পান। বুধনির একটি মেয়েও হয়। মায়ের সঙ্গে মেয়েরও সাঁওতাল সমাজে ঠাঁই পায়নি।

জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে 'নেহেরুর বউ'/The News বাংলা
জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬০ বছর পরেও একঘরে ‘নেহেরুর বউ’/The News বাংলা

১৯৬২ সালে ডিভিসির চাকরিটিও চলে যায় বুধনির। কুড়ি বছরেরও পর, ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর হস্তক্ষেপে আবার ডিভিসিতে চাকরি পান তিনি। বাড়িও করে দিয়েছে ডিভিসি। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা গেল, তাঁর নাতিকে নাকি সরকার চাকরি দিয়েছে।

রান্না করা থেকে কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার করা এই বয়সেও নিজের হাতেই সব করেন ‘নেহেরুর বউ’। কালের নিয়মে সমাজ আজ বদলেছে অনেকটাই। একঘরে হয়ে থাকার নিয়ম শিথিল হয়েছে। কিন্তু যে সমাজ তাঁকে বিতাড়িত করেছিল, সেখানে আর তিনি ফিরে যাননি। অভিমানে চাননি তাঁর জীবন নিয়ে সিনেমা হোক।

আরও পড়তে পারেনঃ মকর সংক্রান্তি, পৌষ পার্বণ ও পিঠাপুলি উত্‍সবের অজানা পৌরাণিক কাহিনি

আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, উৎসব-আনন্দ-সামাজিকতা, সমস্ত কিছু থেকে তিনি নিজেকে ব্রাত্য করে রেখেছেন আজও। নিজেকে স্বেচ্ছায় ব্রাত্যই করে রাখতে চান শহুরে মানুষদের কাছ থেকেও। ঝাড়খণ্ডের গ্রামে আজও সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন ‘বাইরের একটা লোকে’র গলায় মালা দেওয়া সাঁওতালি মেয়ে।

আরও পড়তে পারেনঃ পৃথিবী জুড়ে কমছে শিশু, চরম সমস্যায় বিশ্ব সমাজ

জওহরলাল নেহেরুর পর ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন দেশের ক্ষমতা পাবার জন্য লড়ছেন রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। কিন্তু, দীর্ঘ ৬০ বছর লড়াই করার পর এখন ফিরে আসার লড়াই ছেড়ে, না ফেরার লড়াই করছেন ‘নেহেরুর বউ’ বুধনি। একদিন এই সমাজ তাঁকে ত্যাগ করেছিল, আর আজ এই সমাজকেই পরিত্যাগ করেছে অভিমানী সাঁওতালি মেয়ে।

আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে The News বাংলা পড়তে লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন