বেমালুম উধাও হয়ে যান; শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে ইঞ্জেকশন দেওয়া নার্স রাজদুলারী টিকু। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হিন্দু মহাসভার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা; এবং জনসংঘ দলের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু; আজও ভারতবাসীর মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। জওহরলাল নেহেরুর আমলে, কাশ্মীরে শেখ আবদুল্লার হাতে ব’ন্দি অবস্থায়; শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর কারণ আজও ভারতবাসীর কাছে রহস্য। কাশ্মীরে জওহরলাল নেহেরু ও শেখ আবদুল্লার পুলিশ কাস্টডিতে; অদ্ভুতভাবে মৃ’ত্যু হয় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। আর অনেকটাই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মত উধাও হয়ে গিয়েছিলেন; শ্যামাপ্রসাদকে শেষ ইঞ্জেকশন দেওয়া নার্স রাজদুলারী টিকু।
কাশ্মীর উপত্যকার সু’ন্নী মু’সলিমদের একটি অংশের নেতা; শেখ আবদুল্লার সঙ্গে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর দারুণ সখ্যতা গড়ে ওঠে। শেখ আবদুল্লার আবদারে, ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারাটি ঢোকাতে; উঠে পরে লাগেন নেহেরু। এই ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরে থাকবে আলাদা সংবিধান, আলাদা পতাকা; ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের মানুষ এখানে জমি কিনে থাকতে পর্যন্ত পারবেন না; কোন কাশ্মীরি মেয়েকে বিয়েও করতে পারবে না।
তখনও বাবাসাহেব আম্বেদকরের নেতৃত্বে সংবিধান সভা; সংবিধান রচনার কাজ করছে। আম্বেদকর দেশের অ’খণ্ডতা বিরোধী, জাতীয় স্বা’র্থবিরোধী এই কা’লাকানুন; সংবিধানে ঢোকাতে পরিষ্কার অস্বীকার করেন। তখন নেহরু ঘুরপথে সংসদ হয়ে, এই আইনকে পাশ করিয়ে; সংবিধানে ঢোকাতে বাধ্য করেন। নেহরুর প্রশ্রয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর নেতা শেখ আবদুল্লা; বাদশাহ-র মতো কাশ্মীর শাসন শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ নেহরুর আশীর্বাদ ও সমর্থন নিয়ে; তিনি নিজেকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করলেন, মুখ্যমন্ত্রী নয়।
১৯৫২ সাল নাগাদ অবস্থাটা এরকম দাঁড়াল যে, ভারত রাষ্ট্র, জম্মু-কাশ্মীরকে যার অবিচ্ছিন্ন অংশ বলে মনে করা হচ্ছে; দুজন প্রধানমন্ত্রী, নেহরু ও আবদুল্লা; দুজন রাষ্ট্রপ্রধান, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও কাশ্মীরের সদর-ই-রিয়াসৎ; দুটি সংবিধান, তার মধ্যে কাশ্মীরেরটি তখনও লিখিত হচ্ছে ও দুটি পতাকা। দেশের এই অসম্মানের বিরুদ্ধেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করেন; “এক দেশ মে দো বিধান, দো প্রধান ঔর দো নিশান নেহি চলেঙ্গে’; এক দেশের মধ্যে দুরকম সংবিধান, দুই প্রধানমন্ত্রী ও দুই পতাকা চলবে না।
আরও পড়ুনঃ বাংলার বাঘের ছেলে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ তৈরির ভূমিকার কথা জানুন ও জানান
ইতিমধ্যেই গোঁ’ড়া সু’ন্নী শেখ আবদুল্লা-র সা’ম্প্রদায়িক ও পক্ষ’পাতদুষ্ট শাসনের ফলে; জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ অঞ্চলের কাশ্মীরি পণ্ডিত, ডোগরা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, শিয়া মুসলিম ও বিভিন্ন উপজাতীয় মু’সলিম জনগোষ্ঠী সবাই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিল। জম্মুর অবিসংবাদিত নেতা প্রেমনাথ ডোগরা-র নেতৃত্বাধীন জম্মু-কাশ্মীর প্রজা পরিষদের ওপর; শেখ আবদুল্লার পুলিশ ভয়াবহ দ’মনপী’ড়ন, হ’ত্যা, নারী ধ’র্ষণ নামিয়ে আনে। লড়াই শুরু করে কাশ্মীরের হিন্দুরা; তাঁরা ভারতীয় সংবিধান ছাড়া কিছুই মানতে রাজি ছিলেন না।
এই ন্যায্য দাবীকে সমর্থন জানাতেই, ১৯৫৩ সালের ১১ মে পারমিট ছাড়াই; (তখন জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে ভারতীয়দের পারমিট করাতে হত) জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে গিয়ে জম্মুর মাধোপুর সীমান্তে শেখ আবদুল্লা-র পুলিশ শ্যামাপ্রসাদকে গ্রেফতার করে। সেখান থেকে তাঁকে ডাল লেকের তীরে; একটি ছোট্ট কুটিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিনা বিচারে তাঁকে প্রায় ৪০ দিন, আটক করে রাখার পর; কাশ্মীরের একটি হাসপাতালে খুবই রহস্যজনকভাবে ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন ভোর ৩টা ৪০ মিনিটে মাত্র ৫১ বছর বয়সে শ্যামাপ্রসাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
একথা পরে প্রমাণ হয়েছিল যে, ভারত সরকার বিনা অনুমতিতে; কাশ্মীর প্রবেশের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করেনি। আসলে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ভয় পেয়েছিলেন। যদি তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কাশ্মীরে ঢুকে; জনসাধারণের কাছে প্রকৃত সত্যটা তুলে। তাহলে চরম বিপদ। বিশেষ করে জনরোষের কবলে পড়বেন তিনি। অতএব তাঁরই নির্দেশে কাশ্মীর সরকার; শ্যামাপ্রসাদকে গ্রেফতার করে জন নিরাপত্তা আইনে।
গ্রেফতার করার পরে শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে আসা হয়; কাশ্মীর সেন্ট্রাল জেলে। পরে হঠাৎ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত একটি কুটিরে। শ্যামাপ্রসাদের অপরাধ ছিল, তিনি কাশ্মীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জানতে চেয়েছিলেন; কাশ্মীর-বাসীরা কী চান। কাশ্মীর-বাসীরা কেমন আছেন। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে নিয়েই শুরু করবেন জন আন্দোলন; নেহরু তা মেনে নিতে পারলেন না। অগত্যা শ্যামাপ্রসাদ ও তার দুই সঙ্গীকে একরাতের জন্য, শ্রীনগর সেন্ট্রাল জেলে রাখলেও; পরদিনই তাদের নিয়ে যাওয়া হল এক অজানা জায়গায়। ডাল লেক তীরবর্তী পাহাড়ের খাড়াই চূড়ায় এক ছোট্ট কুটিরে; চারপাশে কোনো বসতি নেই; কোনও চিকিৎসালয় নেই।
কাশ্মীর তাঁর দেখাশনার দায়িত্বে থাকা নার্স রাজদুলারী টিক্কু পরে জানান; সেদিন গভীর রাতে ডাক্তারের নির্দেশ মতো তিনি একটি ইঞ্জেকশন শ্যামাপ্রসাদকে দেওয়ার পর তিনি প্রচণ্ড ছটফট আর চিৎকার করতে লাগলেন, ‘জ্বল যাতা হ্যায়, হামকো জ্বল রাহা হ্যায়’। তারপরেই শ্যামাপ্রসাদ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ও সব শেষ হয়ে যায়। মৃত্যুর অফিসিয়াল কারণ; হার্ট অ্যা’টাক।
আরও পড়ুনঃ কলকাতা জানতেই পারেনি, তার ‘পাগল প্রেমিক’ ছেড়ে চলে গেল চিরবিদায়ে
২৩ জুন সকালেও ব্যারিস্টার ত্রিবেদী; সুস্থই দেখে গেলেন শ্যামাপ্রসাদকে। দু-একদিনের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে; ছাড়া পেয়ে যাবেন শ্যামাপ্রসাদ; এমনটাই বলা হল। ঐদিনই ভোর পৌনে চারটের সময় ব্যারিস্টার ত্রিবেদীকে খবর দেওয়া হল; শ্যামাপ্রসাদের অবস্থা ভালো নয়। গুরু দত্ত বেদ, টেকচাঁদ, পন্ডিত প্রেমনাথ ডোগরা প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে; ব্যারিস্টার ত্রিবেদী যখন হাসপাতালে পৌঁছলেন ততক্ষণে সব শেষ। হাসপাতালের বক্তব্য ৩.৪০ মিনিটেই মারা গেছেন শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু কীভাবে? কেন?
নার্সের বয়ান অনুযায়ী, ‘যন্ত্রণায় কাতর শ্যামাপ্রসাদকে ইঞ্জেকশন রেডি করে দিয়েছিলেন চিকিত্সক; সেই ইঞ্জেকশন শ্যামাপ্রসাদের শরীরে পুশ করেছিলেন নার্স রাজদুলারী টিকু। তারপরেই ছটফট করতে করতে মারা যান; বাংলা ও হিন্দুদের রক্ষাকর্তা শ্যামাপ্রসাদ। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পর কাশ্মীরে গিয়ে, নার্স রাজদুলারির সঙ্গে দেখা করেছিলেন; শ্যামাপ্রসাদের কন্যা সবিতা এবং তাঁর স্বামী নিশীথ। পরিচয় গোপন করেই তারা দেখে এসেছিলেন; পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত সেই কুটির, যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদকে।
তারপর অনেক অনুসন্ধান করে পৌঁছেছিলেন রাজদুলারীর কাছে। রাজদুলারী সব সত্য ফাঁস করে দিয়ে; ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, “আমি পাপ করেছি, মহাপাপ”। শ্যামাপ্রসাদের মেয়ে সবিতার চোখের জল; তাকে সত্য বলতে বাধ্য করে। তারপরই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান; আর তাঁর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরদিন সেই বাড়িতে গিয়ে সবিতাদেবী; আর রাজদুলারীকে দেখতে পাননি। আজও তিনি নিখোঁজ; কেউ জানে না তিনি কোথায়। যেমন নিখোঁজ শ্যামাপ্রসাদের গুরুত্বপূর্ণ ডায়েরি; প্রেসক্রিপশন এবং সেই ইনজেকশনের অ্যাম্পুলটিও।
শুধু সরকারি সত্য হিসেবে বেঁচে আছে; হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসান। রহস্যজনক ভাবে, বেমালুম উধাও হয়ে যান; শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে শেষ ইঞ্জেকশন দেওয়া নার্স রাজদুলারী টিকু। সারা দেশব্যাপী শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু রহস্যের তদন্ত দাবী করা হলেও; কোন এক অজ্ঞাত কারণে প্রধানমন্ত্রী নেহরু কোনরকম তদন্ত করাতে রাজী হলেন না।
শ্যামাপ্রসাদের মা যোগমায়া দেবী একটি চিঠিতে নেহরুকে লেখেন যে; “আপনি সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছেন। আমি মনে করি আমার পুত্রের অকালমৃ’ত্যুর জন্য; জম্মু-কাশ্মীর সরকার দায়ী। আমি আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করছি যে; এই যো’গসাজসে আপনারাও আছেন। কিন্তু সত্য একদিন উদ্ঘাটিত হবেই; ও এর জন্য আপনাকে দেশের মানুষ ও ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে হবে”।