শান্তনু সরস্বতী, কলকাতা: বিশ্বের সেরা জাতীয় ফুটবল দলগুলির সঙ্গে ঠিক যেমন একদল চিকিৎসক থাকেন, আফ্রিকার দেশগুলির প্রতিটি ফুটবল দলের সঙ্গে ঠিক তেমনই থাকেন উইচ্ ডক্টর বা তান্ত্রিক। পুরো আফ্রিকান ফুটবলটাকেই গত পঞ্চাশ বছর ধরে শাসন করে চলেছে এই উইচ্ ডক্টররা। এ এক অদ্ভুত দুনিয়া, অবাক করা গল্প। যেখানে ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও, বিশ্বাস করেন যাদুমন্ত্রে। পড়ুন তিন খণ্ডের সেই ‘অবিশ্বাস্য সত্যে’র দ্বিতীয় পর্ব।
পড়ুন প্রথম পর্বঃ পৃথিবী এগোলেও তান্ত্রিকের কালো জাদু টোনায় ডুবে আফ্রিকা
ডেনিস ম্যাচিও লেখেন, ২০০২ সালে আফ্রিকান নেশনস্ কাপ চলাকালীন ক্যামেরুনের জাতীয় দলের তদানীন্তন কোচ, উইনি স্ক্যাফারের সহকারী থমাস কনোকে দেখা যায় গোপনে স্টেডিয়ামের টার্ফ খুঁড়ে সেখানে মানুষের একটা হাড় পুঁতে রাখতে। থমাস কনোকে খেলার মাঠে জাদু প্রয়োগের অপরাধে পরে গ্রেফতার করা হয়।
নব্বইয়ের দশকে রোয়াণ্ডা বনাম উগাণ্ডার মধ্যে একটি ম্যাচেও অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। দূর্বল রোয়াণ্ডাকে শুরু থেকেই চেপে ধরে উগাণ্ডা। কিন্তু প্রথমার্ধেই উগাণ্ডার নেওয়া তিনটে শট বারে লেগে ফিরে আসে। দুটি শট গোলমুখে থাকলেও অদ্ভূতভাবে দিক পরিবর্তন করে বাইরে চলে যায়। রোয়ান্ডা বারবার বেঁচে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ক্যামেরায় দেখা যায় রোয়াণ্ডার গোলপোস্টের নেটের সাথে এক জোড়া গ্লাভস সুতা দিয়ে বাঁধা।
দর্শকদের মতে নেটের সঙ্গে বাঁধা গ্লাভসই রোয়াণ্ডাকে বারবার রক্ষা করছিলো। এ নিয়ে উগান্ডা এবং রুয়াণ্ডার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অনেকে আহত হয়।প্রায় ৫ ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসলে আবার খেলা শুরু হয়। দূর্বল রোয়ান্ডা ওই ম্যাচে উগান্ডার বিরুদ্ধে ১-০ গোলে জয়লাভ করে।
বছর দশেক আগে তানজানিয়ার এক ফুটবলারকে ফুটবল মাঠ থেকে গ্রেফতার করে ওই দেশের পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সেনিজের দলের মৃত এক ফুটবলারের কবরে মুরগির রক্ত ছেটাচ্ছিল। পুলিশি জেরায় সে স্বীকার করে যে, মৃত ওই ফুটবলারের ড্রিবলিং স্কিল নিজের করে নিতেই সে অমন কাজ করছিলো।
ব্ল্যাক ম্যাজিক বা যাদুটোনায় বিখ্যাত রজার মিল্লার দেশ ক্যামেরুন। বছর দশেক আগেও, ব্ল্যাক ম্যাজিকের কারণেই ক্যামেরুনিয়ানদের ভয় পেত প্রতিপক্ষের ফুটবলাররা। কুখ্যাতি ছিলো সবসময়।
বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক মারিসা পাইন তাঁর একটি ফিচার স্টোরিতে সম্প্রতি লিখেছেন, ১৯৯৪ বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচ খেলতে ক্যামেরুনে গিয়েছিল প্রতিবেশি দেশ নাইজেরিয়া। তারা ক্যামেরুনিয়ানদের ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে এতোটাই ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলো, যে বিমান থেকে নেমে হোটেলে না গিয়ে দূতাবাসের গাড়িতে করে সরাসরি নাইজেরিয়ো দূতাবাসেই চলে যায় তারা। আর সেখানেই রাত কাটায়। ক্যামেরুনের পাঠানো বাস পর্যন্ত তারা ব্যবহার করেনি। ওঠেনি ওদের জন্য রিজার্ভড হোটেলেও।
মারিসা পাইন লিখেছেন, ১৯৯১ সালে ক্যামেরুনের জাতীয় লিগে ডায়মণ্ড অব ইয়াউণ্ড বনাম কেইমান ডুয়ালা-এর ম্যাচটি নিয়েও বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। রেফারি বাঁশি বাজানোর পরপরই কোথা থেকে যেন একটা বাজপাখি এসে কেইমান-এর পোস্টের ওপর বসে পড়ে। আর আশ্চর্যজনক ভাবে ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার পরেই বাজপাখিটা উড়ে চলে যায়।
ম্যাচে গোলকিপার অতিমানব হয়ে ওঠার কারণেই হারা ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়ে কেইমান ফুটবল ক্লাব। ডায়মণ্ড অব ইয়াউন্ড ক্লাব সমর্থকরা অভিযোগ করে যে গোলকিপার নয়, ওই বাজপাখিটাই ওইদিন কেইমান-এর গোলপোস্ট রক্ষা করছিলো। এ নিয়ে ম্যাচের শেষে দুই দলের সমর্থকরা তুৃমুল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
রাজধানী লাগোস থেকে প্রকাশিত প্রভাতী দৈনিক, দ্য প্রেডিক্টর পত্রিকার স্পোর্টস সম্পাদক, জর্জ অ্যাকপায়েনের মতে, আফ্রিকানদের ব্ল্যাক ম্যাজিক নির্ভরতা আর বিশ্বাস এতটাই বেশি, যে পারিবারিক বিরোধের সময় পরিবারের সদস্যদের উপর কার্স প্রয়োগ করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।
২০১৪ সালে টোগোর সুপারস্টার ইমানুয়েল আদেবায়োর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তার ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য দায়ী তার মা। মায়ের সঙ্গে বিরোধের পর দীর্ঘদিন ধরে তার মা আদেবায়োর ওপর ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রয়োগ করছিল বলে সে অভিযোগ করে। প্রায় একইরকম অভিযোগ করে ঘানাইয়ান সুপারস্টার মাইকেল এসিয়েন। মাইকেল তার বাবাকে ওর ওপর ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রয়োগ করার জন্য দায়ী করে।
আইভরিকোস্ট তারকা গ্র্যাডেল ২০১৩ সালে মারাত্মক ইনজুরির শিকার হয়ে প্রায় এক মরসুমের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান। ইনজুরির জন্য গ্র্যাডেল তার বোন ডেবরাহকেই দায়ী করে। পরবর্তীতে জর্জ অ্যাকপায়েন ডেবরাহকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, “এটা আমাদের অবহেলা করার শাস্তি”। আইভরি কোস্টের একটি দৈনিকেও ডেবোরাহকে দায়ী করে বলা হয় যে, পারিবারিক বিবাদের কারণেই গ্র্যাডেলের পরিবার তার উপর জাদু প্রয়োগ করছে।
আইভরি কোস্ট ও চেলসি লেজেণ্ড দিদিয়ের দ্রোগবাও স্বীকার করে যে, তার আইভরি কোস্টের সতীর্থ জিয়েন জ্যাকস টিজিয়ে পরিবারের সদস্যদের করা কালো জাদু থেকে মুক্তি পেতে বিশেষ আচার অনুষ্ঠান পালন করতো।
পড়ুন প্রথম পর্বঃ পৃথিবী এগোলেও তান্ত্রিকের কালো জাদু টোনায় ডুবে আফ্রিকা
পড়ুন তৃতীয় ও শেষ পর্বঃ পৃথিবী এগোলেও তান্ত্রিকের কালো জাদু টোনায় ডুবে আফ্রিকা