সনাতন হিন্দু ধর্মকে ছোট করার চেষ্টা সফল হবে না

5660
Image Source: Google

পৌলমী পাল, কলকাতা: সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট কেরলের শবরিমালা মন্দিরে সব বয়সের মহিলাদের প্রবেশাধিকার অবাধ করেছেন। তাতে হিন্দুধর্ম কতটা গোঁড়া, পুরুষতান্ত্রিক, মহিলাদের সমানাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা অসহিষ্ণু সেটাই আলোচনা হচ্ছে। কারণ, এই একবিংশ শতকে এসেও যদি দেবস্থানে প্রবেশাধিকার পেতে সুপ্রিম কোর্টের কড়া নাড়তে হয়, তাহলে সেটা সত্যিই খুব চিন্তার বিষয়!

আচ্ছা, শবরিমালা মন্দির ছাড়া ভারতের আর কোন মন্দিরে কি মহিলাদের উপর নিষেধাজ্ঞা কি নেই ? একনজরে দেখা যাক,
শবরিমালা ছাড়াও ভারতের কোন কোন মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ :-

১। কার্তিকেয় মন্দির, হরিয়ানা ও পুষ্কর।
২। ভবানী দীক্ষা মন্ডপম, বিজয়ওয়াড়া।
৩। রাজস্থানের রনকপুরের জৈন মন্দিরে রজঃস্বলা অবস্থায় নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ।
৪। কেরলের পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে মহিলারা পুজো দিতে পারলেও গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে পারেন না।

কী? এবার সত্যিই মনে হচ্ছে তো, যে হিন্দুধর্মে নারীরা বঞ্চিত! কিন্তু দাঁড়ান, আগে জেনে নিই এই বাধা, এই নিয়ম কী শুধু মেয়েদের জন্যেই? ভারতে কি কোনো মন্দির বা ধর্মীয় উৎসবে পুরুষদের কি এভাবে ব্রাত্য করে রাখা হয়?

উত্তর হলো―হ্যাঁ হয়। আমাদের দেশে প্রায় ৫টি মন্দির আছে যেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ:-

১। আট্টুকাল মন্দির, কেরল :- হ্যাঁ, এটা সেই শবরিমালার রাজ্যেরই একটা মন্দির যেখানে শুধুমাত্র মহিলারা প্রবেশ করতে পারেন। এমনকী সেখানকার বিখ্যাত “পোঙ্গল” উৎসবেও পুরুষরা অংশ নিতে পারেন না। ফি বছর, প্রায় তিরিশ লক্ষ মহিলার স্বতস্ফূর্ত সমাগমে জমজমাট এই উৎসব “গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড” এ স্থান পেয়েছে। পুরুষদের কোন স্থান নেই এখানে।

২। চাক্কুলাত্থুকাভু মন্দির, কেরল :– ভগবানের আপন দেশের দ্বিতীয় মন্দির, যেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। দেবী ভগবতীর এই মন্দিরে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের প্রথম শুক্রবার আয়োজন করা হয় এক বিশেষ নারীপূজা, যে পুণ্যদিনের স্থানীয় ভাষায় নাম “ধনু”। উপবাসী ব্রতকারিণীদের পা ধুইয়ে দেন, মন্দিরের ‘পুরুষ’ পুরোহিত! বাকি কোন পুরুষ প্রবেশ করতে পারেন না !

৩। ব্রহ্মা মন্দির,পুষ্কর, রাজস্থান :- পুরাণ অনুযায়ী, দেবী সরস্বতী দ্বারা অভিশপ্ত এই মন্দিরে কোনো বিবাহিত পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কথিত আছে, পুষ্কর জলাশয়ের তীরে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন ব্রহ্মদেব। অর্ধাঙ্গিনী দেবী সরস্বতী সময়মতো উপস্থিত না হতে পারায়, উপায়ান্তর না দেখে, ব্রহ্মা দেবী গায়েত্রীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন ও যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। ক্রুদ্ধ দেবী সরস্বতী অভিশাপ দেন, মন্দিরে কোনো বিবাহিত পুরুষ প্রবেশ করলে, তার বিবাহিত জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। চতুর্দশ শতাব্দীর এই মন্দিরে তাই পুরুষরা ব্রাত্য।

৪। ভগবতী মন্দির, কন্যাকুমারী :- এই মন্দিরে একমাত্র মহিলারা ও সন্ন্যাসী পুরুষই দেবী দুর্গার কুমারী রূপের দর্শন পাওয়ার অধিকারী। বাকি পুরুষদের প্রবেশাধিকার নেই।

৫। ভগবতী মাতা মন্দির, বিহার:- বিহারের মুজাফ্ফরপুরের ভগবতী মাতা মন্দিরে বছরের একটি বিশেষ সময়ে, পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। সেই সময় শুধু মহিলারাই প্রবেশ করতে পারেন মন্দিরে।

এখানেই শেষ নয়, ভারতের একটি মন্দিরে পুরুষ ও মহিলা কাউকেই গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

ত্রিম্বক্যেশ্বর মন্দির, মহারাষ্ট্র : আগে ত্রিম্বক্যেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে পারতেন না মহিলারা। পুরুষরাও যদিও সকালে একঘন্টার জন্যই প্রবেশাধিকার পেতেন সেখানে। সমানাধিকার প্রদান করে ন্যায় সাধন করতে, মাননীয় বোম্বে হাইকোর্ট ২০১৬ সাল থেকে, গর্ভগৃহে পুরুষদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করেন।

দুর্গাপূজায় কুমারী পুজো বা নবরাত্রির “কন্যা পূজন”, কই সেখানে তো কোনো ছেলেকে পুজো করা হয় না।শুধু মেয়েদেরই পুজো হয়। ছেলেরা কি এবার আদালতে যাবে, কুমার পুজো করার দাবী তুলে ?! হিন্দু ধর্মের অনেক আচার অনুষ্ঠানই শুধু মহিলাদের যেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

কি বলবেন এইসব শুনে? পুরুষের সমানাধিকার লঙ্ঘন? আসলে, প্রত্যেক ধর্ম বা ধর্মস্থানের কিছু নিজস্ব সংস্কার বা নিয়মকানুন থাকে। ক্ষতিকারক না হলে, আদালতের সেখানে নাক না গলানোই ভালো বলেই মনে হয়।

ঠিক যে কারণে, গুরুদ্বারে গেলে মাথা ঢাকতে হয়, মসজিদে গেলে ইসলামসম্মত পোষাক পরতে হয়, ঠিক সেই কারণেই একজন ব্রহ্মচারী ভগবান আয়াপ্পার মন্দিরে রজস্বলা নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ।

এখানে, মাথায় রাখতে হবে আমাদের মন্দিরগুলো, কোনো মিউজিয়াম নয়, যে সেখানে কেবল সেল্ফি তুলতে বা ঘুরতে যাওয়া হয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে কোটি কোটি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও সংস্কার। তাই সেটা নিয়ে ছিনিমিনি না খেলাই ভালো।

কেউ নাস্তিক হতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে অন্য মানুষের বিশ্বাসে নাক গলানোর অধিকার তার নেই। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই শবরিমালা মন্দিরের রায়ের পরও এমন অনেক মহিলা থাকবেন, যারা মন্দিরের বিশ্বাসের, এতদিনের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মন্দিরে ঢুকবেন না। সেই শ্রদ্ধাকে বুঝতে না পেরে, প্রগতিশীলতার নামে, এগুলোকে পুরুষতান্ত্রিক মগজধোলাই বলে অতিসরলীকরণ না করাই ভাল।

এবার দেখা যাক, শবরিমালা মামলার প্রধান আবেদনকারী কে? Indian Young Lawyers Association বলে একটি সংগঠন। যার সভাপতির নাম নওশাদ আহমেদ খান!

ওনার এই সমানাধিকার পাইয়ে দেওয়ার লড়াই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতো না, যদি উনি শবরিমালার সাথে, নিজামুদ্দিন দরগার (দিল্লি) সংরক্ষিত স্থানে মহিলাদের প্রবেশাধিকার নিয়েও সরব হতেন। অথবা দিল্লির জামা মসজিদে, মাগরিবের নমাজেও যাতে মহিলারা অংশ নিতে পারেন, সেই নিয়েও সওয়াল করতেন।

উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনতালাক, নিকাহ হালালা প্রভৃতি মুসলিম মেয়েদের অধিকার নিয়ে করা গুরুত্বপূর্ণ মামলা সম্পর্কে কিন্তু ভদ্রলোকের বা তাঁর সংগঠনের কোনো বক্তব্য জনসমক্ষে নেই। এসব ব্যাপারে, ওনার এই অদ্ভুত নীরবতা সত্যিই বেদনাদায়ক।

এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলি। ভারতবর্ষে মোট মন্দিরের সংখ্যা কতো? ২০ লক্ষেরও ওপরে। সেখানে এই লিঙ্গভিত্তিক প্রবেশাধিকার নিয়ে বাধা কতোগুলোতে আছে? নারী-পুরুষ সব মিলিয়ে কুড়িটাও হবে না বোধহয়।

আর শুধু নারী ধরলে? পাঁচটা। আচ্ছা, তর্কের খাতিরে আরও পাঁচটা যোগ করে দেওয়া গেল। মোট দশটা। তাহলে শতাংশের হিসেবে কী দাঁড়াচ্ছে। ২০ লক্ষে খুব বেশী হলে ১০টা = ০.০০০৫%। আর বাকী ৯৯.৯৯৯৫% মন্দিরে কিন্তু এরকম কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।

সেখানে এই একটা শবরিমালা মন্দির নিয়ে বিগত একমাস ধরে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন হিন্দুধর্মের প্রায় সব মন্দিরেই মহিলাদের প্রবেশাধিকার নেই। হিন্দুধর্ম একটা চরম নারীবিদ্বেষী ধর্ম, এখনো, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মহিলাদের শোষণ করে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এবার আরেকদিকে দেশে মসজিদের সংখ্যা আর তার মধ্যে কতোগুলোতে মহিলাদের প্রবেশাধিকার আছে। প্রবেশাধিকার থাকলেও, দূরে অন্যপাশে কোন অচ্ছুতের মতো বা পর্দার আড়ালে বসার বদলে, পুরুষদের সাথে একই স্থানে বসে নামাজ পড়ার, প্রার্থনা করার অধিকার আছে, সেটা এবার একটু খুঁজে দেখুন।

বাকী মসজিদের কথা বাদ দিন, ভারতের সবথেকে প্রগতিশীল দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ক্যাম্পাসে যে মসজিদগুলো আছে, সেগুলোতেই মহিলাদের নামাজ পড়ার কোন ব্যবস্থা নেই। সেসব নিয়ে কোন আন্দোলন, ফেসবুক বিপ্লব, মামলা কিছু হয়েছে? কেউ দেখেছেন?

এই যে এতো এতো প্রগতিশীল, নারীবাদী, এমনকি নাস্তিকরাও হঠাৎ করে হিন্দু নারীদের পুজো করার অধিকার নিয়ে এতো সচেতন হয়ে উঠেছিলেন, হিন্দুধর্ম কতোটা খারাপ সেই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পাতার পর পাতা লিখে বিপ্লব করলেন, তাঁদের কাউকে এসব নিয়ে একটাও কোন মন্তব্য করতে দেখেছেন?

তাই শেষে, একটা কথাই বলতে চাই যে, এই একপেশে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত “নারীর সমানাধিকার” এর লড়াইতে মেতে উঠার আগে নিজের অধিকার আর লড়াইয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হোন। সনাতন ভারতের হিন্দু মন্দিরগুলির ইতিহাস ও রেওয়াজ জানুন। পড়ুন বুঝুন, তারপর সিদ্ধান্তে আসুন। “ঝাঁকের কৈ” হবেন না।

*(লেখার বক্তব্য সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব)

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন