কলকাতা: শুধুই কি দুর্ঘটনা ? শুধুই কি মানুষের ব্যক্তিগত গাফিলতি ? একের পর রেল সংক্রান্ত দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর আসল কারণটা কি ? আসলে সাধারণ মানুষের জীবনের কোন মূল্যই নেই। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি, আমজনতার জীবন ঠিক বাড়ির পোষা গরু-ছাগলের মত। বাঁচলো কি মরলো, কিছুই এসে যায় না।
একদম তাই। আপনার আমার সাধারণ মানুষের জীবনের কোন দামই নেই। সরকার বা প্রশাসনের কাছে আমজনতার জীবনের কোন মূল্য নেই। এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা আবার সেটাই প্রমান করে। সাধারণ মানুষের জীবনের দাম এখন কুকুর ছাগলের চেয়েও কম।
ঘটনা ১: পাঞ্জাবের অমৃতসরের ধোবিঘাটে, দশেরায় রাবণদাহ অনুষ্ঠান চলছিল। সেটি দেখতে কমপক্ষে সাত হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই ধোবিঘাটের জোড়া ফটক ক্রসিংয়ের কাছে রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন। কারণ সেখান থেকে রাবণ দাহের দৃশ্য অনেক ভালো দেখা যায়। বাজির তীব্র আওয়াজের মধ্যেই জলন্ধর-অমৃতসর ট্রেন, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের পিষে দিয়ে চলে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে পাশের লাইনে চলে আসে অমৃতসর-হাওড়া এক্সপ্রেস। ঘটনায় ৬০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু।
ঘটনা ২: পশ্চিমবঙ্গের সাঁতরাগাছি রেল স্টেশনের ফুটব্রিজে পদপিষ্ট হন বহু যাত্রী। ঘটনায় এখনও পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, আরও অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে রয়েছে দুই শিশুও। আহতদের মধ্যে আরও ১ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাওড়া হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। সাঁতরাগাছি স্টেশনে একসঙ্গে ৩ টি ট্রেন এসে দাঁড়ায়। ফলে, একসঙ্গে অনেক লোক ফুটব্রিজে উঠে যাওয়ায় পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। সেই সময় পদপিষ্ট হন যাত্রীরা।
অমৃতসর এর ঘটনা প্রমান করে দেয়, সাধারণ মানুষের জীবনের কোন দামই নেই। রেললাইনের কাছে সাধারণ মানুষের এত বড় একটা উৎসবের খবরই নেই রেলের কাছে। উদ্যোক্তারাও রেলকে জানানোর বা সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কোন প্রয়োজন বোধ করেন নি।
অন্যদিকে, বাস স্ট্যান্ডে বাস ধরার কথাই বলুন বা রেল স্টেশনে ট্রেন ধরার কথাই বলুন, পাবলিক আড্ড্রেস সিস্টেমে যে কোন পরিষেবার ঘোষণা হয় একেবারে শেষ মুহূর্তে। সেই কারণেই, প্রতিদিন ভারতের কোথাও না কোথাও জীবন হাতে নিয়ে সাধারণ মানুষকে ছোটাছুটি করতে হয়। যে কোনদিন সাঁতরাগাছি-র মত পদপিষ্ট হবার ঘটনা আবার যেখানে খুশি ঘটতে পারে।
বিহার, উত্তরপ্রদেশ বা ভারতের যে কোন বড় মন্দিরেই বলুন বা পুরিতে জগন্নাথ দেবের রথ টানার কথাই বলুন, এটা ধরেই নেওয়া হয়, পদপিষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যু যে কোনদিন হতে পারে। হুড়োহুড়িতে মহিলা-বাচ্চা সহ মানুষ মরবে এটাই যেন স্বাভাবিক। ব্যপারটা এখন এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, ১৩০ কোটির দেশে কটা লোক মরলো তো কি এসে গেল !!!
সরকারি হিসাব বলছে, শেষ কয়েক বছরে ভারতে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের হাতে টাকা এসেছে। কিন্তু, এই সব রিপোর্টই হচ্ছে উচ্চবিত্তদের জন্য। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার মান কতটা কমেছে বা চাষী কৃষক মজদুরদের জীবনধারণ কতটা কঠিন হয়েছে তা আর হিসাবে আসে না।
উচ্চবিত্ত সমাজের একটি দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর খবর যতটা হইচই ফেলে আমজনতার জীবনের বড় দুর্ঘটনাও অতটা প্রভাব ফেলতে পারে না। একজন রাজনীতিবিদের জীবনে একটি দুর্ঘটনা বা মৃত্যু যতটা খবরের শিরোনামে আসে, শয়ে শয়ে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা কিছুই রেখাপাত করে না।
শুধু দেশ নয়। আমাদের রাজ্যের কথাই দেখুন। বিষ মদ খেয়ে প্রায়ই লোক মরছে। প্রশাসন ২ লাখ দিয়েই জীবনের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। অথবা, বিষ মদ রুখতে রাজ্য সরকার নিজেই পাড়ায় পাড়ায় মদের লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছে। রাজস্ব বাড়াবার নামে খেয়ালখুশি সিদ্ধান্ত। আসল কথা কিন্তু সেই গোড়াতেই লুকিয়ে। আমার আপনার জীবনের কোন দামই নেই।
কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। তার চেয়েও পাল্লা দিয়ে কমছে সাধারণ মানুষের জীবনের দাম। দেশ হোক বা রাজ্য, আমজনতার জীবনের কোন দামই নেই। মানুষের জীবনের মূল্য শুন্য।
শুধু একদিন সেই জীবনের মূল্য বোঝা যায়, ভোটের দিন। ভোটের আগে হাত জড়ো করে নেতা নেত্রীদের আপনাকে সম্মান দেওয়াটাই আপনার জীবনের মূল্য। বাকি দিনগুলিতে সরকার বা প্রশাসনের কাছে বা সরকারি আধিকারিকদের কাছে নেতা নেত্রী বা উচ্চবিত্ত মানুষ ছাড়া আমজনতার জীবনের কোন নিরাপত্তাও নেই,কোনও মূল্যই নেই।
দুর্ঘটনা ঘটছে, ঘটবেও। কারণ কোন মতে বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষের জীবনের দাম কানাকড়িও নয়। মৃত্যুর পর দানের ২ লাখ বা ৫ লাখেই মানব জীবনের দাম ধরা থাকে। কীট পতঙ্গের জীবন আমজনতার, মরলেই কি আর বাঁচলেই কি ? আমাদের রাজ্য তথা দেশে এটাই ধ্রুব সত্য।