১৩৪৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন হিন্দু রাজা কাশ্মীর শাসন করে। এর পরে শুরু হয় একের পর এক বহিরাগত মুসলমানদের আক্রমণ। শুরু হয় ধর্মান্তকরণ। সবথেকে বেশী ধর্মান্তকরণ করা হয় ঔরঙ্গজেব এর শাসনকালে। বর্তমানকালের বেশীরভাগ কাশ্মীরি মুসলমানই ধর্মান্তরিত কাশ্মীরি পন্ডিত, বলেই জানান ঐতিহাসিকরা।
২০ অক্টোবর ১৯৪৭, জিন্নার নবগঠিত পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করল। জিন্নার শ্লোগান ছিল, ‘কাশ্মীর বনেগা পাকিস্তানকা’। নৃশংস হত্যালীলা চালাতে চালাতে তারা পৌছে যায় শ্রীনগরের দোরগোড়ায়। কাশ্মীরের এক বিরাট অংশ চলে গেল তাদের দখলে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন এর উপস্থিতিতে সাক্ষরিত হল “Instrument of Accession”। দিনটা ছিল ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭। জম্মু-কাশ্মীর এক ভারতীয় রাজ্য হয়ে গেল দুভাগ।
প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আদেশ দিলেন পাকিস্তানীদের হটানোর, শুরু হোল স্বাধীনতার পর ভারত এবং পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধ। ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরের প্রায় দুই -তৃতীয়াংশ পুনুরুদ্ধার করে ফেলার পর পুরোটা ফের দখল না করেই নেহেরু যুদ্ধ থামাতে বলেন। মাঝপথে যুদ্ধ থেমে গেল। নেহেরুর এই অমার্জনীয় ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ভারত করতে থাকবে চিরকাল। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সময়ে পাকিস্তান যতটা জায়গা ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলো তা হল পাকিস্তানের কাছে “আজাদ কাশ্মীর”।
এরপর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় কাশ্মীর বেশ শান্ত ছিল। মুসুলমান ও কাশ্মীরি পন্ডিত শান্তিতে সহাবস্থান করেই ছিল। তৈরী হয়েছিল এক অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যাকে বলা হয় “কাশ্মীরিয়াত”। কিন্তু ধর্মের বিষ মেরে ফেলল প্রতিবেশী সুলভ ভালোবাসাকে।
এরপরেই পাক উস্কানিতে ১৯৯০ এর ১৯শে জানুয়ারি থেকে কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিতদের নিধন শুরু হল। তার আগের বছর থেকেই ফারুখ আবদুল্লা সরকার সেখানকার কুখ্যাত জঙ্গীদের জেল থেকে ছাড়তে শুরু করেন। অন্তত ৭০জন জঙ্গি ১৯৮৯ এর জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে কাশ্মীরের জেল থেকে ছাড়া পায়। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিহত হওয়াটা তখন যেন ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা।
১৯৯০ এর ৪ঠা জানুয়ারি, হিজবুল মুজাহিদিন-এর আফতাব একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে ঘোষনা করলেন, সমস্ত হিন্দুদের কাশ্মীর ছাড়তে হবে। আল-সাফা বলে অন্য একটি সংবাদপত্রেও একই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হল। ক্রমশঃ পন্ডিতদের ঘরের দরজায় দরজায় কাশ্মীর ছাড়ার নোটিশ লটকানোর প্রক্রিয়া শুরু হল। চুপ ছিল ফারুখ আবদুল্লা সরকার। এমনকি কেন্দ্রিয় সব সরকারই।
তখন উপত্যকা জুড়ে শুধু একটাই আওয়াজ, “পণ্ডিত মুক্ত কাশ্মীর”। রাস্তায় রাস্তায় এবং উপত্যকা জুড়ে এমন মিছিল আর স্লোগান, এই কাশ্মীর ও তার “কাশ্মীরিয়াত” আগে কখনও দেখেনি। পালিয়ে যাওয়া পণ্ডিতদের অভিযোগ, কাশ্মীরের সমস্ত মসজিদ একসঙ্গে ঘোষণা করল যে, কাশ্মীরকে পাকিস্তান বানাতেই হবে।
নিজেদের সম্মান ও জীবন বাঁচাতে, তখন হাতের কাছে যে যা পেলেন তাই নিয়েই বেশীরভাগ পন্ডিতই তাদের বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে পড়িমরি করে পালাতে শুরু করলেন। যেনতেন প্রকারেন সেখান থেকে পালাবার জন্য তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।
ট্রাক-লরির ক্যানভাসের ছাউনীর আড়ালে, বাস কিংবা ভাড়ার ট্যাক্সিতে চড়ে শুরু হল পণ্ডিতদের ঘর ছেড়ে পালানোর নির্মম কাহিনী। শুরু হল কাতারে কাতারে হিন্দুর উপত্যকা ত্যাগের রক্তাক্ত ইতিহাস। সারা দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী মহল সবাই নিরুত্তর রইলেন, একটি শব্দ ভুলেও কেউ উচ্চারণ করলেন না।
বিখ্যাত কাশ্মীরি শিক্ষাবিদ, সর্বানন্দ কাউল প্রতিদিন যেখানে তিলক পরতেন, কপালের ঠিক সেই অংশে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকে তাঁকে হত্যা করা হল। বিকে গাঞ্জোকে তার বাড়িতে খুন করে সেই রক্ত মাখানো ভাত খেতে নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁর সদ্যবিধবা পত্নীকে। নার্স শ্রীমতী সরলা ভাটকে গণধর্ষণ করে তাঁর উলঙ্গ মৃতদেহটিকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয়।
মাট্টানের রবীন্দর পন্ডিত এর শবদেহের উপর আততায়ীরা আনন্দে নৃত্য করে। সোপিয়ানে শ্রী ব্রিজলাল ও ছোটির মৃতদেহকে জীপের সঙ্গে বেঁধে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দীপুরার স্কুলশিক্ষিকা শ্রীমতী গিরজা টিক্কো ও নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করার আগে কাশ্মীরি মুসলিমদের হাতে গণধর্ষনের শিকার হন।
ভুলে যাওয়া ইতিহাস ভুলে যারা এখনও কথা বলেন, নিজের জন্মভূমি থেকে পালিয়ে কাশ্মীরি পন্ডিতরা তাদের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে থাকেন। তাঁদের রক্তাত্ব ইতিহাস যে মূর্খরা জানে না, সেটা তাঁরা খুব ভাল রকমই জানেন। তাই আজও যখন কাশ্মীরে সেনার বিরুদ্ধে বা বিছিন্নতাবাদি কাশ্মীরিদের স্বপক্ষেই সবাই বলেন, তখন একরাশ উপহাস দিয়ে নিজেদের রক্তাত্ব ইতিহাস জানার আর্জি রাখেন কাশ্মীরি পন্ডিতরা।
আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে The News বাংলা পড়তে লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।