জনগণকে বোকা বানিয়ে নেহেরুর পরিবারতন্ত্রের পথেই দেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ

567
জনগণকে বোকা বানিয়ে শিক্ষাগুরু নেহেরুর যোগ্য ছাত্র দেশের সব রাজনীতিবিদ/The News বাংলা
জনগণকে বোকা বানিয়ে শিক্ষাগুরু নেহেরুর যোগ্য ছাত্র দেশের সব রাজনীতিবিদ/The News বাংলা

মুখে নেহেরু পরিবারের তুমুল সমালোচনা; কিন্তু কাজে সবাই সেই পরিবারতন্ত্রেরই অন্ধ সমর্থক। এই বিষয়ে ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলের ‘শিক্ষাগুরু’ সেই জওহরলাল নেহেরু। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। নেহেরু পরিবারকে সমালোচনা; অথচ ভারতে সবাই সেই পরিবারতন্ত্রের পক্ষেই।

পুরসভা থেকে রাজ্য হয়ে দেশ। নেহেরু পরিবারের মতই; সবাই চায় পরিবারতন্ত্র। মুখে কিন্তু নেহেরু পরিবারের তুমুল সমালোচনা। কারণ নেহেরু পরিবার; ভারতে পরিবারতন্ত্রের সূচনা করেছে। জওহরলাল নেহেরু; ইন্দিরা গান্ধী; রাজীব গান্ধী; সনিয়া গান্ধী; রাহুল গান্ধী; বংশপরম্পরায় কংগ্রেসে পরিবারতন্ত্র চলেছে।

সেই পরিবারতন্ত্র এখনও চলছে। আর তার তুমুল সমালোচনা করে এসেছে; কংগ্রেস বিরোধী সব রাজনৈতিক দল। কংগ্রেসকে ‘নেহেরু-গান্ধী পরিবারের লিমিটেড কোম্পানী’; বলেছেন মোদী-অমিত শাহ। কিন্তু মুখে কংগ্রেস পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বললেও; কাজে সেই জওহরলাল নেহেরুকেই অন্ধ অনুসরণ করছে ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল।

তেলেঙ্গানায়; তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতির অবস্থা দেখুন। মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও-র মন্ত্রিসভার; একাধিক মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর আত্মীয়। তাঁর প্রায় সব আত্মীয়ই বিভিন্ন পদের মাথায়। চন্দ্রশেখরের ছেলে কে রামা রাও; রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী। রিগেশন, মার্কেটিং এবং লেজিসলেটিভ অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী; টি হরিশ রাও চন্দ্রশেখর রাওয়ের ভাইপো। শুধু ছেলে ভাইপোই নন। মেয়ে কবিতাও সাংসদ। এছাড়াও আরও অনেক আত্মীয়কে; বিভিন্ন পদের মাথায় বসিয়ে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের পরিবারতন্ত্রের সুযোগ্য বাহক তিনি।

মধ্যপ্রদেশের দিকে তাকান। একসময় মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের পাশাপাশি; মধ্যপ্রদেশে যার বিরুদ্ধে ডাম্পার দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিল কংগ্রেস; সেই সঞ্জয় সিং মাসানিকে বিধানসভা নির্বাচনে টিকিট দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। সবচেয়ে বড় কথা; সঞ্জয় সিং মাসানি আর কেউ নন; খোদ বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের শ্যালক।

এখানেও কংগ্রেসকে টেক্কা দিচ্ছে বিজেপি। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়র পুত্র আকাশকে; টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। অটলবিহারী বাজপেয়ির ভাইপো অনুপ মিশ্রকেও; মধ্যপ্রদেশে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বাবুলাল গৌড়ের পুত্রবধূ কৃষ্ণাও; বিজেপি প্রার্থী ছিলেন। রাজনৈতিক মহলে চর্চা; যে বিজেপি পরিবারতন্ত্র নিয়ে কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে; সেই বিজেপিই মধ্যপ্রদেশে একই কাজ করছে!

তবে নেহেরু গান্ধী পরিবারতন্ত্রকেও টেক্কা দিয়েছেন; বর্তমানের ‘নেতাজী’ মুলায়ম সিংহ যাদব। যাদব পরিবারের কর্তা প্রথম থেকেই সমাজবাদী পার্টির জাতীয় সভাপতি। সেই পদ এখন গিয়েছে ছেলের দখলে। মুলায়ম নিজে দুদফায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন। এখন আজমগড়ের বিদায়ী সাংসদ। বড় ছেলে অখিলেশ যাদব; ২০০০ সালে কনৌজ থেকে প্রথমবার সাংসদ। এখন দলের জাতীয় সভাপতি ও উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।

বড় বউমা ডিম্পল যাদব সাংসদ। ছোট ছেলে প্রতীক যাদব এর স্ত্রী অপর্ণা যাদবও বিধায়ক। বড় ভাই শিবপাল যাদব; একসময় রাজ্যের ডি-ফ্যাক্টো মুখ্যমন্ত্রী; সেচ এবং পুর্ত দফতরের মন্ত্রী থেকেছেন। মুলায়ম ও শিবপালের সব আত্মীয় স্বজনই এমএলএ বা এমপি হয়ে পরিবারতন্ত্রের ফসল।

বিহারে লালুপ্রাসাদ যাদবের পরিবারতন্ত্রের কথা; কে না জানে। স্ত্রী রাবড়ি দেবীকে মুখ্যমন্ত্রী করা; ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কমেডি বলেই মনে করা হয়। ছেলে, শ্যালক, মেয়ে মিশা ভারতী ছাড়াও আরও অনেক আত্মীয়; এমএলএ বা এমপি বা উচুঁ পদে। লালুর পরিবার নেহেরু-গান্ধী পরিবারের যোগ্য অনুসরণকারী।

জম্মু ও কাশ্মীরের মুফতি মহম্মদ সাঈদ-মেহবুবা মুফতি; ফারুক আবদুল্লা-ওমর আব্দুল্লা; মহারাষ্ট্রে বাল থাকারে-উদ্ধব থাকারে-আদিত্য থাকারে; প্রণব মুখোপাধ্যায়-অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়; মানেকা-সঞ্জয় গান্ধীর ছেলে বরুণ গান্ধী। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা; রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া; প্রমোদ মহাজনের মেয়ে। কাকে ছেড়ে কার কথা শুনবেন! প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম-পুত্র কার্তি পি চিদাম্বরম; প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা-ছেলে জয়ন্ত সিনহা; রাজ্যসভার সাংসদ মুরলী দেওয়ারা-ছেলে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী মিলিন্দ দেওয়ারা।

এনসিপি প্রধান প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পাওয়ার-মেয়ে সুপ্রিয়া পাওয়ার; প্রয়াত কংগ্রেস নেতা মাধবরাও সিন্ধিয়া-ছেলে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া; প্রয়াত নেতা রাজেশ পাইলট-ছেলে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সচিন পাইলট; প্রয়াত জিতেন্দ্র প্রসাদ-ছেলে জিনিত প্রসাদ; প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী তথা অভিনেতা সুনীল দত্ত-মেয়ে প্রিয়া দত্ত।

প্রমোদ মহাজন-মেয়ে পুনম মহাজন। দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা সাহিব সিং বর্মা- ছেলে প্রবেশ। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভুপেন্দ্র সিং হুড্ডা-পুত্র দীপেন্দ্র। অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-ছেলে গৌরব। শীলা দীক্ষিত-ছেলে সন্দীপ।

ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন কুমার-ছেলে অভিষেক। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং-ছেলে রাজবীর। হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভজনলাল- ছেলে কুলদীপ। হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌতলা-ছেলে দুষ্মন্ত চৌতলা। রামবিলাস পাশোয়ান-ছেলে চিরাগ। কর্ণাটকে জনতা দল(সেকুলার) প্রধান এইচ ডি দেবগৌড়া-তাঁর ছেলে এইচ ডি কুমারস্বামী এখন কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কর্ণাটকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এস বাঙ্গারাপ্পা-মেয়ে গীতা শিবরাজকুমার। উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রীয় লোকদল প্রধান অজিত সিং-ছেলে জয়ন্ত চৌধুরি।

তামিলনাড়ুর করুণানিধি ও তাঁর পরিবার পরিবারতন্ত্রে; কোন অংশে নেহেরু-গান্ধি পরিবারের চেয়ে কম নয়। ওড়িশায় বিজু পট্টনায়েক পরিবার; পাঞ্জাবে অমরিন্দার সিং পরিবার; উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর ভাই-ভাইপো। উদাহরণ আরও আছে; আরও অনেক। ভারতে পরিবারতন্ত্রের এই গল্প শেষ হবার নয়। পরিবারতন্ত্রের ঘটনা লিখতে শুরু করলে; তা মহাভারত হয়ে যাবে। গোটা ভারতে সব রাজনৈতিক দলেরই একই হাল। জনগণকে গাধা বানিয়ে রেখে; চলছে সেই পরিবারতন্ত্রেরই পুনরাবৃত্তি।

বাংলার দিকে তাকালে সেখানেও সেই এক ইতিহাস। গানিখান চৌধুরী পরিবার যদি বাংলায় পরিবারতন্ত্রের শিক্ষক হয়; তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত। পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকারী পরিবার থেকে ‘ভাইপো’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়; মুকুল রায়-শুভ্রাংশু, মানস ভুঁইয়া-তাঁর স্ত্রী গীতা রানী ভুঁইয়া; সবই তো মমতার হাত ধরে।

এমনকি বিধানসভা লোকসভা আসনগুলোর পর; কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর পদগুলোকেও এবার কুক্ষিগত করে নিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। যেদিকেই তাকাবেন সেই পরিবারতন্ত্র। সে অরূপ-স্বরূপ-জুঁই বিশ্বাস বলুন বা একদম হালে ১১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটে জেতা মেয়র পারিষদ তারক সিং এর ছেলে অমিত সিং। ইতিহাস সেই এক; পরিবারতন্ত্র। কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জন-দীপা দাশমুন্সী বা বামেদের ক্ষেত্রে লক্ষণ শেঠ- তমালিকা পণ্ড শেঠ সেই পরিবারতন্ত্রেরই উদাহরণ।

এটাই সত্য যে, মঞ্চে উঠে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের পরিবারতন্ত্রের কথা বললেও; প্রায় সব রাজনৈতিক দলই জওহরলাল নেহেরুর দেখানো পথেই হাঁটতে পছন্দ করে। আর সেই পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই নেতাদেরই; ভাষণ শুনে আমরা হাততালিও দি। সেই হাততালিটা যে আমাদের বোকামোর জন্যই; সেটাই এখনও বুঝতে পারি নি আমরা। শিরদাঁড়াহীন ভারতবাসী; ‘রাম-দুর্গা-গরু-পাকিস্তান’ নিয়ে বোকার মত ব্যস্ত থাকা ভারতবাসী; আদৌ কি কোনদিন সেটা বুঝতে পারবে?

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন