The News বাংলা, কলকাতা: কোনো কুইজের আসরে ‘ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পের জনক কে’? এমন প্রশ্ন করলে অবধারিত উত্তর আসবে দাদাসাহেব ফালকের নাম। সঞ্চালকও হয়তো উত্তরটাকে সঠিক বলে দেবেন। এদেশে এমনই হয়! মিথ্যা বা অর্ধসত্যই সত্য বলে প্রতিপন্ন হয়। উত্তরটা হীরালাল সেনও হতে পারে।
দাদাসাহেব ফালকে-কেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক বলে জানি সবাই। ফালকের তোলা প্রথম চলচ্চিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ এখনও সংরক্ষিত আছে আর হীলালালের তোলা সমস্ত চলচ্চিত্র ও তাঁর স্টুডিও বিধ্বংসী আগুনে ভস্মিভূত হয়ে যায়। গবেষণায় এখন এটা প্রমাণিত সত্য যে, দাদাসাহেব ফালকে নয় হীরালাল সেনই উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জনক।
১৯১৩তে ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ নামে দাদা সাহেব ফালকে যে কাহিনীচিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন সেটাই দেশের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, কিন্তু প্রথম চলচ্চিত্র নয়। ফালকের ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯১৩র মে মাসে আর তার বেশ বছর আগে অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতের মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামের এক যুবক হীরালাল সেন ইংল্যান্ড থেকে যন্ত্রপাতি এনে চলমান ছবি বানিয়েছিলেন।
বলা যায় হীরালাল সেন যেখানে শেষ করেছিলেন দাদাসাহেব ফালকে শুরু করেছিলেন সেখান থেকেই। ফালকের ‘রাজা হরিশচন্দ্রে’র আগে ১৮৯৭ থেকে ১৯১৩র মধ্যে হীরালাল নির্মাণ ও প্রদর্শন করেছিলেন চল্লিশটি চলমান ছবি (থিয়েটারের দৃশ্য, বিজ্ঞাপন চিত্র ও দলিল চিত্র বা ডকুমেন্টারি)। এবং তাঁর চলচ্চিত্র প্রদর্শণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি’।
স্থিরচিত্র থেকে চলমান ছবিতে পৌছানোর প্রক্রিয়ায় বহু মানুষের অনেক আবিস্কার ও পরীক্ষা-নিরিক্ষার পথ পেরিয়ে ফ্রান্সের ল্যুমিয়ের ভাইরা–অগাস্ট ল্যুমিয়ের ও লুই ল্যুমিয়ের ১৮৯৬ এর ২৯শে জুন প্যারিসে প্রথম ‘সিনেমাটোগ্রাফ’ যন্ত্রে চলমান ছবির প্রদর্শন করেছিলেন। বায়োস্কোপ তখন বিশ্বের এক অত্যাশ্চর্য বস্তু। আর দু বছরের মধ্যেই সেই অত্যাশ্চর্য বস্তুর নির্মাণ ও প্রদর্শনের কৃৎকৌশল আয়ত্ব করে ফেললেন তৎকালীন ভারতের ঢাকার মাণিকগঞ্জের ৩২ বছরের বাঙালি যুবক হীরালাল সেন।
হীরালালের জন্ম ১৮৬৬ সালে ঢাকা থেকে আশি মাইল দূরে মাণিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে। পিতা চন্দ্রমোহন সেন ও মাতা বিধুমুখী দেবী। শিক্ষা মাণিকগঞ্জ মাইনর স্কুল ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। কলকাতায় গিয়ে ভর্তি হন কলেজে। এই সময় হীরালাল আকৃষ্ট হন ফোটগ্রাফি ও চলচ্চিত্রের প্রতি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে। কম বয়স থেকেই ফোটোগ্রাফির প্রতি দুর্বার আকর্ষণ ছিল হীরালালের।
১৮৯০ নাগাদ নিজ গ্রাম বাগজুরিতে নিজের ঘরেই একটা স্টুডিও বানিয়ে ফেলেছিলেন। স্টুডিওর নাম দিয়েছিলেন ‘এইচ এল সেন এন্ড ব্রাদার্স’। বয়সে তিন বছরের ছোট ভাই মতিলাল সেনকেও টেনে এনেছিলেন।
কলকাতা তখন থিয়েটারের শহর। বাঙালির সেরা বিনোদন তখন থিয়েটার, আর কলকাতার নাট্যাকাশে রয়েছেন উজ্বলতম জ্যোতিষ্ক অমরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর ‘ক্লাসিক থিয়েটার’। অমরেন্দ্রনাথের সহায়তায় ক্লাসিক থিয়েটারে বায়োস্কোপ দেখালেন হীরালাল- মতিলাল ১৮৯৮এর ৪ঠা এপ্রিল।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাতেও বায়েস্কোপ প্রদর্শিত হয় সদর ঘাটের ক্রাউন থিয়েটারে। রয়েল বায়েস্কোপ কোম্পানি পরে বাংলাদেশে আরও অনেক এলাকায় বায়োস্কোপ দেখায়। এর মধ্যে রয়েছে বগজুরি, জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ (১৫ এপ্রিল, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ); ঢাকার নবাববাড়ি (২০ ও ২৪ মার্চ, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ)।
এইসব ছিল ছুটন্ত ঘোড়া, উড়ন্ত পাখি, চলন্ত ট্রেন ইত্যাদির চলন্ত ছবি। তাতে তো কোন গল্প নেই! এবার হীরালাল ভাবলেন নাট্যকাহিনীর চলমান ছবি দেখানোর। বিলেত থেকে ক্যামেরা ও চলচ্চিত্র তৈরির যন্ত্রপাতি আনালেন। ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনীত একের পর এক নাটকের দৃশ্যাবলী ধরে রাখলেন সেলুলয়েডে।
‘আলিবাবা’, ‘সীতারাম’, ‘ভ্রমর’, ‘মৃণালিনী’, ‘বুদ্ধদেব’, ‘দোললীলা’ প্রভৃতি মঞ্চ-সফল নাটকের চলচ্চিত্র বানালেন। নাটকের দৃশ্য ছাড়াও হীরালাল তাঁর বায়োস্কোপে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মিছিলের দৃশ্যও চলচ্চিত্রায়িত করেছিলেন, তুলেছিলেন বিজ্ঞাপন চিত্র ও চিৎপুর রোড নিয়ে একটি তথ্যচিত্র। অর্থাৎ শুধু চলচ্চিত্রই নয়, হীরালাল সেন ভারতের তথ্যচিত্র ও বিজ্ঞাপন চিত্রেরও জনক।
হীরালাল সেন পরবর্তী মুভি শট নেন মঞ্চস্থ নাটক ‘আলীবাবা’ থেকে। তাঁরা তোলা দৃশ্যের মধ্যে ছিল পাহাড়ের গুহাতে দস্যুদের আগম-প্রস্থান, হুসেনের মণি-মুক্তা, জহরত দেখে আত্মহারা হয়ে যাওয়া এবং আবদাল্লা-মর্জিনার নৃত্যদৃশ্য।
এসব দৃশ্যে অভিনয় করেন অমরেন্দ্রনাথ (হুসেন), নৃপেন্দ্র বসু (আবদাল্লা) এবং কুসুম কুমারী (মর্জিনা)। কুসুম কুমারী ছিলেন সেকালের বিখ্যাত নটী। কুসুম কুমারী ঢাকায় এসেও অভিনয় করেছেন। হীরালাল সেনের হাতে চিত্রায়িত দৃশ্যের মাধ্যমে কুসুম কুমারী প্রথম নায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হন।
ইতিমধ্যে হীরালালের তৈরি করা পথ ধরে দেশি-বিদেশী অনেকেই বায়োস্কোপ প্রদর্শনের ব্যবসায়ে নেমে পড়েছেন। ময়দানে তাঁবু খাঁটিয়ে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেছেন জামশেদজি ফ্রামজি ম্যাডান আর আর্থিক জোগান না থাকায় পিছিয়ে পড়লেন হীরালাল। ভাই মতিলালও আলাদা হয়ে গিয়ে দখল নিলেন হীরালালের ‘রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানী’র ।
নীঃস্ব হীরালাল শেষে ছবি বানানো থেকে সরেই গেলেন। এদিকে শরীরও ভেঙে পড়েছে, দেহে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার। এমন কি অর্থকষ্টের চাপে সাধের ক্যামেরা দুটিকেও বন্ধক রেখেছিলেন। টাকা জোগাড় করে সেই ক্যামেরাদুটি আর ফিরিয়ে নিতে পারেন নি। ১৯১৭’র ২৮শে অক্টোবর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র একান্ন বছর বয়সে মারা গেলেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জনক হীরালাল সেন।
হীরালালের মৃত্যুর কয়েকদিন পরে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে ভষ্মিভুত হয়ে যায় মতিলালের দখলে থাকা হীরালালের স্মৃতি বিজড়িত রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানির সমস্ত যন্ত্রপাতি,ফিল্ম ও নথিপত্র। সেই অগ্নিকান্ডে মৃত্যু হয় ভাই মতিলালের কন্যা অমিয়বালারও।
হীরালালের তৈরি তথ্যছবি “Anti-Partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town Hall, Calcutta on 22nd September 1905” ভারতের তথা বিশ্বের প্রথম রাজনীতিক চলচ্চিত্র বলে গণ্য করা হয়। ১৯০৫-এর ২২শে সেপ্টেম্বর কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি প্রতিবাদ সভা হয়েছিল, এ ছবিতে সেটাই ক্যামেরাবন্দি করা হয়। ১৯০৫-এ এই ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা’। ছবির শেষে গাওয়া হয়েছিল “বন্দে মাতরম”।
কিন্তু ভাগ্যের খেলায় হীরালাল সেনের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে আখ্যায়িত হন বোম্বের দাদা সাহেব ফালকে। যদিও তিনি অনেক পরে ১৯১২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করে করেন এবং ১৯১৩ সালে তৈরী করেন ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। হীরালাল সেন ১৯০৩ সালেই তৈরী করেছিলেন কাহিনীচিত্র নির্ভর ‘আলী বাবা ও চল্লিশ চোর’।
চলচ্চিত্র গবেষকদের মধ্যে কারও কারও ধারণা প্যারিস, লন্ডন বা আমেরিকার আর্কাইভগুলোতে খুঁজলে হয়তো এখনো পাওয়া যেতে পারে তার কোনও নির্মিত চলচ্চিত্র। ফালকের নামে সিনেমা শিল্পের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয় কিন্তু হীরালাল সেনের নামে খাস কলকাতায় একটা রাস্তারও নামকরণ হয়নি।
শোনা যায়, ঢাকাতে তাঁর নামে একটি রাস্তা আছে। সেখানে ‘ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজ অফ বাংলাদেশ’ প্রতি বছর ‘হীরালাল সেন স্মারক বক্তৃতা’র আয়োজন করেন। তারা মনে রেখেছেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনককে, এদেশে আমরা রাখিনি।
এভাবেই ইতিহাসের পাতায় ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে ও যাবে হীরালাল সেনের স্বীকৃতি। আমাদের উচিৎ তাঁর কাজের যোগ্য মর্যাদার দাবি করা ও বিশ্ব চলচ্চিত্র মহল থেকে স্বীকৃতি আদায় করা। হীরালাল সেনই এই উমপহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার বা ফার্স্ট ফিল্ম মেকার।
এখন, হীরালাল সেনের জীবনী উঠে আসতে চলেছে সিলভার স্ক্রিনে। অরুণ রায় পরিচালিত এই ছবির নাম ‘হীরালাল’। ছবিতে দেখানো হবে তৎকালীন কলকাতা। সঙ্গে উঠে আসবে বেশ কিছু কিংবদন্তি চরিত্রও। যেমন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। অভিনয় করছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখেরা।
আজ চলচ্চিত্র শিল্পের কত রমরমা,আকাশচুম্বী তার জনপ্রিয়তা। কিন্তু, ইতিহাসের নির্মাণ যারা করেন তাঁদের সবাইকে আর কে মনে রাখে! উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জনক তেমনই একজন।