শান্তনু সরস্বতী, কলকাতা: বিশ্বের সেরা জাতীয় ফুটবল দলগুলির সঙ্গে ঠিক যেমন একদল চিকিৎসক থাকেন, আফ্রিকার দেশগুলির প্রতিটি ফুটবল দলের সঙ্গে ঠিক তেমনই থাকেন উইচ্ ডক্টর বা তান্ত্রিক। পুরো আফ্রিকান ফুটবলটাকেই গত পঞ্চাশ বছর ধরে শাসন করে চলেছে এই উইচ্ ডক্টররা। এ এক অদ্ভুত দুনিয়া, অবাক করা গল্প। যেখানে ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও, বিশ্বাস করেন যাদুমন্ত্রে। পড়ুন তিন খণ্ডের সেই ‘অবিশ্বাস্য সত্যে’র তৃতীয় ও শেষ পর্ব।
পড়ুন প্রথম পর্বঃ পৃথিবী এগোলেও তান্ত্রিকের কালো জাদু টোনায় ডুবে আফ্রিকা
ক্যামেরুনের প্রবাদপ্রতিম ক্রীড়া সাংবাদিক, বাসিল কে মবুয়ে বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর একটি লেখায় প্রশ্ন তোলেন, তান্ত্রিকরা কি সত্যিই পারেন মাঠে প্রভাব বিস্তার করতে? ক্যামেরুনের ব্যামেণ্ডার অধিবাসী তান্ত্রিক মুহাম্মদ দাবী করেন, তিনি খেলার মাঠে বল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। গোলকিপারের উপরও প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। তার মতে, “পারফর্মেন্সে উন্নতির জন্য ইউরোপিয়ানরা যেমন নিষিদ্ধ ড্রাগের ব্যবহার করে, আফ্রিকানরাও তেমনই ব্যবহার করে জাদুশক্তি”।
নাইজেরিয়ান তান্ত্রিক এ্যালিও ব্যানকেম এর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, “নিজেদের গোলপোস্ট রক্ষা করতে আমি প্রেতাত্মার সাহায্য নিয়ে থাকি। প্রেতরাই ম্যাচ জেতাতে সাহায্য করে আমাদের দলকে।” নাইজেরিয়ার কোন কোন দল ও ফুটবলার ব্যানকেমের সাহায্য নেয়, সেই বিষয়ে অবশ্য মুখ খুলতে রাজি হয়নি সে।
পড়ুন দ্বিতীয় পর্বঃ পৃথিবী এগোলেও তান্ত্রিকের কালো জাদু টোনায় ডুবে আফ্রিকা
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফুটবলারের স্ত্রী বলেন, “তান্ত্রিকেরা আফ্রিকান ফুটবলারদের কাছে কোচের চেয়ে কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা যদি আমার স্বামীকে ফুটবল খেলতে মানা করে, সে আর কখনওই বলে লাথি মারবে না।”
শুধু আফ্রিকাই নয়, ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাহায্য নিয়মিত নিয়ে থাকে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ফুটবলার ও ক্লাব, এমনই তথ্য উঠে এসেছে। কলকাতা ময়দানেও এই ব্ল্যাক ম্যাজিকের বেশ দাপট ছিল বলেও জানা গিয়েছে।
ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে লিখতে বসলে বেনশাদি ট্র্যাজেডির কথা না লিখলে, সম্পূর্ণ হবে না। খুব সম্ভবত সময়টা ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাস। রাজধানী ব্রাসাভিলে থেকে প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার দূরের শহর বেনশাদি। কঙ্গো সেসময় জাতিদাঙ্গার শিকার হলেও বেনশাদি শহরে দাঙ্গার প্রভাব তখনও পড়েনি। স্থানীয় কোকাকোলা কাপের খেলায় মুখোমুখি হয় বেনশাদি এফসি ও বাসাংগার এফসি। ম্যাচ শুরু বিকেলে। মধ্যানের বিরতির সময় ম্যাচের ফলাফল ১-১।
দ্বিতীয়ার্ধে নিজেদের মাঠে বেনশাদি তখন একের পর এক আক্রমণের ঝড় তুলছে বাসাংগার ডিফেন্সে। হঠাৎই মাঠে উপস্থিত সকলকে অবাক করে আচমকাই বজ্রপাত হয় মাঠের মধ্যে। এর পরেই বেনশাদি এফসির ফুটবলার থেকে শুরু করে কোচিং স্টাফেরা একে একে লুটিয়ে পড়ে মাঠে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের সকলকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। ওই একটি বজ্রপাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বেনশাদি এফসি। এগারোজন ফুটবলার ও কোচিং স্টাফ ছাড়াও বেনশাদির দর্শকসহ ওইদিন মারা যায় মোট ৩০ জন।
কিন্তু, বজ্রপাতে মৃত্যুতে অস্বাভাবিকতা কোথায়? অস্বাভাবিকতা হলো এই যে, বাসাংগা এফসির কোনও ফুটবলার ওইদিন ন্যূনতম আহতও হয়নি। অক্ষত অবস্থায় মাঠ ছাড়ে তারা। এই ঘটনায় বেনাশাদি এফসির সমর্থকরা দাবি করে নিশ্চিত বাসাংগা এফসি বেনশাদি এফসির ওপর ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রয়োগ করে যার ফলে মৃত্যু হয় ৩০ জনের।
এই ঘটনাটির কথা শুধুমাত্র কঙ্গোর প্রভাতী দৈনিকগুলিই নয়, বেশ সোরগোল ফেলে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। তবে দিন কয়েকের মধ্যে গৃহযুদ্ধের আঁচ বেনশাদি শহরেও আঁছড়ে পড়ায়, ওইদিনের ওই ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছুই জানা যায়নি।
পরবর্তীতে টিভি শো আরবান লেজেন্ডস-এর একদল সাংবাদিক বেনাশাদি শহরে গিয়ে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে। সেখানকার মানুষ মৃত্যুর জন্য এখনও বাসাংগা এফসিকেই দায়ী করে। আজ পর্যন্ত অনেকে অনেক রকমভাবে ব্যাখ্যা করলেও বেনাশাদি ট্যাজেডি এখনও রহস্যই রয়ে গেছে। ঠিক যেমনটা ফুটবলে ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রভাবের বিষয়টি।
ভাবতেও অবাক লাগে ২০১৮ সালের শেষেও ব্ল্যাক ম্যাজিক বা যাদু টোনায় বিশ্বাসী আফ্রিকান ফুটবল। আর তাই, বিশ্বকাপে ক্যামেরুন বা নাইজেরিয়ার চমকপ্রদ পারফরম্যান্স সত্ত্বেও সেই পিছিয়েই আছে আফ্রিকান ফুটবল।
পড়ুন প্রথম পর্বঃ পৃথিবী এগোলেও তান্ত্রিকের কালো জাদু টোনায় ডুবে আফ্রিকা
পড়ুন দ্বিতীয় পর্বঃ পৃথিবী এগোলেও তান্ত্রিকের কালো জাদু টোনায় ডুবে আফ্রিকা