আমাদের দেশের মুসলিম মেয়েরা সব জায়গায় যেতে পারে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শপিং মল, বাজার, রাস্তা ঘাট, সিনেমা হল, বাসে, অফিস আদালতে, কল কারখানায়,পার্কে, মাজারে, মন্দিরে ইত্যাদি ইত্যাদি সব স্থানেই তারা গমন করে কিন্তু সেক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হয়না, অথচ একমাত্র মসজিদে গেলেই নাকি যত গণ্ডগোল।
মেয়েরা এমনকি ঈদের সালাত পর্যন্ত পড়তে পারে না। অথচ মেয়েদেরকে দলে দলে এমনকি ঋতুকালীন অবস্থাতেও মেয়েদেরকে ঈদগাহে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কারা তাদের একেবারে মসজিদে যাওয়া নিষেধ করে দিল? একটা মেয়ে দুনিয়ার সব স্থানে যেতে পারে অথচ আল্লাহর ঘরে ইবাদত করতে যেতে পারে না, এর চাইতে ভয়াবহ ব্যাপার আর কি হতে পারে?
আরও পড়ুনঃ ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসেও পাক জঙ্গি হামলা, চলছে গুলি গ্রেনেডের লড়াই
অথচ নবির আদেশ ছিল, ‘হজরত সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ(রা) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, নবি(স) বলেছেন,(তোমাদের কারও স্ত্রী মসজিদে যাবার অনুমতি চাইলে তার স্বামী যেন তাকে বাধা না দেয়। অথবা সে যেন বাধাপ্রাপ্ত না হয়’। (সহি বখারি শরিফ, হাদিস নং ৭৭৫) এবার প্রশ্ন দেখা দিতে পারে মেয়েরা কি পুরুষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে। সেখানে বিধান হোল ‘মেয়েদের সারি হবে ছেলেদের একদম পিছনে’।
আরও পড়ুনঃ জয় হিন্দ, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের সোনার অক্ষরে লেখা ইতিহাস
হজরত আনাস(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘একদিন্নবি(স) উম্ম সুলাইমের ঘরে নামাজ আদায় করলেন। আমি আর একটি অনাথ ছেলে তাঁর পিছনে নামাজে দাঁড়ালাম এবং উম্মে সুলাইম আমাদের(সবার) পিছনে দাঁড়ালেন’। (বোখারি শরিফ, হাদিস নং ৭৭৩) এমনকি রাতের আঁধারে যদি মহিলা মসজিদের যেতে চায় তবে যেন বাধা না দেওয়া হয়। হজরত ইবনেনিত(রা) থেকে বর্ণিত, নবি(স) বলেছেন, তোমাদের স্ত্রীরা যদি রাতে মসজিদে আসার অনুমতি চায়, তাহলে তাদেরকে অনুমতি দাও।
আরও পড়ুনঃ ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায়
যদি একটি মেয়ে মসজিদে যেতে পারত, তাহলে মসজিদে যাওয়ার পর তাঁর সাথে আরও ১০টা মেয়ের সাক্ষাত হত। তাঁদের সাথে ধর্মীয় কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা করতে পারত। সে সুযোগটাও তারা পাচ্ছে না। সে যখন দেখছে অন্য ধর্মে সহজেই পুজা অর্চনায়, গির্জায় যাওয়া যায় অথচ মসজিদে যাওয়া যায়না, তাহলে ঠিক কি কারনে অন্য সংস্কৃতি, কালচারে আগ্রহী না হয়ে ইসলামে আগ্রহী হবে ইয়াং জেনারেশনের মেয়েরা?
আজকের সমাজের বিশৃঙ্খলা দূর করতে অনেক বেশি সহায়ক হবে যদি আমাদের মা, বোন ও স্ত্রীরা মসজিদে যাওয়া শুরু করে। আর তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের পুরুষদেরকেই নিতে হবে। মূলতঃ মহিলাদের মসজিদে জামাতে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দেয়ার কারণ হিসেবে জ্ঞান অর্জন করাকেও অনেকে উল্লেখ করেছেন। এবং তা আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, বুখারী শারীফের ৯১৫ নং হাদিসের বর্ণনা দ্বারা।
আরও পড়ুনঃ কালামের নামে ছাত্রদের তৈরি হালকা উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়ে নজির ভারতের
উম্মে আতিয়া রাযি হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন আমাদেরকে বের হওয়ার আদেশ দেওয়া হতো, আমরা কুমারী মেয়েদেরকে, এমনকি ঋতুবর্তী মহিলাদেরকেও নিয়ে ঘর থেকে বের করতাম। অতঃপর পুরুষদের পিছনে থেকে তাদের তাকবীরের সাথে সাথে তাকবীর পড়তাম এবং তাদের দোয়ার সাথে সাথে আমরাও ঐ দিনের বরকত ও পবিত্রতা লাভের দোয়া করতাম’।
এ হাদিসে এবং অন্যান্য আরও হাদিসে স্পষ্টই উল্লেখ রয়েছে যে, ঋতুবর্তী মহিলাগণও ঈদগাহে উপস্থিত হতো। অথচ শরীয়তে ঋতুবর্তী মহিলাদের জন্য নামাজ সম্পূর্ণ হারাম। সুতরাং তাদের ঈদগাহে বা জামাতে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি যদি শুধুমাত্র নামাজের জন্য হতো, তবে ঋতুবর্তী মহিলাগণ ঈদগাহে উপস্থিত হতো না।
আরও পড়ুনঃ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আগে কোন কোন বাঙালি ভারতরত্ন হয়েছেন
শুধু তাই নয়, আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধকার থাকতেই ফজরের সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করতেন। এরপর মু’মিনের স্ত্রীগণ চলে যেতেন, অন্ধকারের জন্য তাদের চেনা যেত না অথবা বলেছেন, অন্ধকারের জন্য তাঁরা একে অপরকে চিনতেন না। (সহীহ বুখারি হাদিস নাম্বার:৭৬৯)
অন্যদিকে একটি হাদি্সে বলা হয়েছে, ‘নারীদের নামাজের উত্তম স্থান হোল তাদের ঘরের নিরজন কোণ’। এখানে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে নারীদের মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য এতো হাদিস রয়েছে সেখানে এই কথা কেন বলা হোল? আমদের বুঝতে হবে কোন একটি ব্যবস্থা রাতারাতি চালু করা যায় না বিশেষ করে যে সময়ে নারীদের কোন অধিকারই ছিল না।
আরও পড়ুনঃ জন্মদিনে নেতাজি সুভাষের মৃত্যুদিন নিয়ে ছেলেখেলা রাহুলের কংগ্রেসের
যেমন মদ্যপানের বিষয়টি। প্রথমে মদ্যপান খারাপ বলা হোল। তারপর বলা হোল, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা মদ্যপান অবস্থায় উপাসনার নিকটবর্তী হয়ো না’। অবশেষে বলা হোল, ‘মদ্যপান শয়তানের কাজ, তাই তোমরা ওর থেকে বিরত থাকো’। (৯শুরা মাআয়িদা, আয়াত নং ৯০) তাই কেও প্রথম আয়াতকে অনুসরণ করে বলতে পারে নামাজের সময় বাদ দিয়ে অন্য সময়ে মদ্যপান করা যেতে পারে। সম্পূর্ণ বিষয়কে অনুধাবন করে তাকে উপলব্ধি করা উচিত।
অন্যদিকে একটি গল্প বাজারে চালু রয়েছে, যেটা হল হজরত উমর(রা) নাকি মেয়েদের মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ করেছিলেন। অথচ আসল সত্য হল, ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমর (রাঃ)-এর স্ত্রী (আতিকাহ বিনত যায়িদ) ফজর ও ইশার সালাত (নামায/নামাজ)-এর জামা’আতে মসজিদে হাজির হতেন।
আরও পড়ুনঃ মোদীর মাস্টারস্ট্রোকে দেশ পেতে পারে প্রথম মহিলা বাঙালি সিবিআই প্রধান
তাঁকে বলা হল, আপনি কেন সালাত (নামায/নামাজ)-এর জন্য বের হন? অথচ আপনি জানেন যে, উমর (রাঃ) তা অপছন্দ করেন এবং মর্যাদা হানিকর মনে করেন। তিনি জবাব দিলেন, তা হলে এমন কি বাধা রয়েছে যে, উমর (রাঃ) স্বয়ং আমাকে (আতিকাহ বিনত যায়িদ) নিষেধ করছেন না? বলা হল, তাঁকে বাধা দেয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বাণী, ‘আল্লাহর দাসীদের আল্লাহর মসজিদে যেতে নিষেধ করো না’। (সহীহ বুখারি (ইফা), অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু’আ। হাদিস নাম্বারঃ ৮৫৪)
উল্লেখ্য ওমর রা, রাসূলুল্লাহ সা এর নির্দেশকে মান্য করে চুপ থেকেছেন। স্ত্রীকে মসজিদে যেতে নিষেধ করেননি। আর বর্তমানের বুজুর্গরা ওমর রা এর চেয়েও একধাপ বেশী এগিয়ে যে, তারা কেউ হাদিসের অংশ কাটছাট করে আবার তাদের কেউ মহিলাদের মসজিদে যাওয়াকে ফ্যাশন বলে। আবার কেউ মসজিদে যাওয়াকে মহিলাদের মসজিদে উপভোগ করার মতো জঘন্য কথা বলে।
আরও পড়ুনঃ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মা দুর্গার সাক্ষাৎ অবতার, পোস্টার কংগ্রেসের
মহিলাদের মসজিদে সালাত আদায়ে, পুন্য লাভের সাথে সাথে তাদের যেভাবে চার দেওয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখা হয়েছে সেই বন্দীদশা থেকে মুক্তির স্বাদ পাবে। জীবনকে নুতনভাবে জানতে এবং বুঝতে শিখবে। তবে দীর্ঘদিনের যে কুসংস্কার বাংলার তথা ভারতের মুসলমানদের মনে বাসা বেঁধে আছে তা এই সামান্য লেখায় দূর হয়ে যাবে তা অলিক কল্পনা।
তবে আশার কথা মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে সমগ্র আরব দেশ সমুহ, ইউরোপ, আমেরিকা এবং ভারতের কেরল থেকে বাংলার শত শত মসজিদে মুসলিম মহিলারা সালাত আদায় করছেন এবং এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একজন মহিলা মসজিদ মুখি মানে গোটা পরিবার শিক্ষিত হবার রাস্তায়।
লেখকঃ আবু সুফিয়ান, পুরুলিয়া জে কে কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
এইপ্রসঙ্গে আরও পড়ুনঃ
মন্দিরে ঢোকার অপরাধে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়ানো হল দুর্গাকে
মন্দিরে ঢুকে বিপ্লবের শাস্তি, পিটিয়ে বৌমাকে হাসপাতালে পাঠাল শাশুড়ি
নারী ঢোকায় ‘অপিবত্র’ শবরীমালা, ‘শুদ্ধ’ করার জন্য বন্ধ মন্দির
ভোরবেলায় শবরীমালা মন্দিরে ঢুকে ইতিহাস সৃষ্টি ‘মা দুর্গার’
আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে The News বাংলা পড়তে লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।