লাইফ বিয়ন্ড ডেথ’, কী ভাবে জানবেন মৃত্যুর পর কী

1842

শান্তনু সরস্বতী, কলকাতা: আত্মা অবীনশ্বর। আত্মার মৃত্যু হয়না। এক দেহ ছেড়ে অন্য দেহ ধারণ করে সে। এর প্রমাণ আমরা বারবার পেয়েছি স্বামী যোগানন্দের লেখা,’অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’, স্বামী অভেদানন্দের লেখা, ‘লাইফ বিয়ন্ড ডেথ’ এবং ভারতবর্ষের সাধূদের নিয়ে লেখা, ‘তপভূমি নর্মদা’ গ্রন্থে।

ঈশ্বরের ওপর অগাধ বিশ্বাস যেমন আমার অটুট, তেমনই বিশ্বাস পরলোক এবং প্রেতচর্চার প্রতি। কবিগুরু প্রেতচর্চা করতেন। তাঁর পুত্রের মৃত্যুর পর প্ল্যানচেটের মাধ্যমে নামিয়ে এনেছিলেন শমীদ্রনাথের বিদেহী আত্মাকে। নশ্বর দেহ ত্যাগের পর আত্মা ঘুমন্ত স্টেট-এ থাকে বলেই কবিগুরু বিশ্বাস করতেন।

আরও পড়ুনঃ জনগণকে ‘গাধা’ বানিয়ে ‘শিক্ষাগুরু নেহেরু’র যোগ্য ছাত্র সব রাজনীতিবিদ

তাই প্ল্যানচেটের মাধ্যমে পরলোকগত কাউকে মিডিয়ামের মাধ্যমে নিয়ে আসতে হলে, তাঁর ওই ঘুম ভাঙাতে হয়। এমনই মতবাদের কথা বলে গিয়েছেন কবিগুরু ও ভারতের সাধকরা।

সাল খুব সম্ভবত ১৯৪৫। পরলোকে উৎসাহী রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্য প্ল্যানচেটের মাধ্যমে কবিগুরুর বিদেহী আত্মাকে নিয়ে এলেন। মিডিয়ামের মাধ্যমে কবিগুরু না কি জানিয়ে ছিলেন, কয়েকজন অবাঙালির হাত ধরে তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ দিয়ে এক আলোকোজ্জ্বল স্থানে পৌঁছিয়েছিলেন। স্বর্গীয় দিলীপ কুমার রায় ও রজনীকান্ত সেন গান গেয়ে কবিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আর দেখা হয়েছিল তাঁর বাবা, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে।

রাজেন্দ্রলাল পরলোক নিয়ে বই লিখবেন শুনে কবিগুরু মিডিয়ামের মাধ্যমে তাঁকে বলেছিলেন,’এইখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই কথা লিখে রেখ বইতে’। এছাড়াও বলেছিলেন আরও অনেক অনেক কথা। বর্ণনা করেছিলেন পরলোকের সৌন্দর্যও।

রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্য এই সমস্ত কথাই লিখে রেখেছেন তাঁর,’মৃত্যুর পরপাড়ে’ গ্রন্থে। রাজেন্দ্রলালের মতো প্রেতচর্চায় বিশ্বাসীদের মতে, পরলোকে সাতটি স্তর আছে। মানুষ তাঁর কর্মফলের ওপর এক একটি স্তরে বিরাজ করে মৃত্যুর পর।

আরও পড়ুনঃ সাধারণ মানুষের জীবনের দাম এখন কুকুর ছাগলের চেয়েও কম

১৯৫৩-তে প্রকাশিত ‘পরলোক সমীক্ষণে’ চক্রপতি ফণীভূষণ নানান অধিবেশনের বর্ণনায় লিখেছেন,’এক আত্মা জানিয়েছেন, নিম্নস্তরের আত্মারা খেতে পান না। আর পঞ্চম স্তরে দেখা মেলে জলের’। প্ল্যানচেটে ‘সত্য বিবরণ’ করাকালীন ফণিভূষণ লিখেছেন, ‘প্ল্যানচেটে পরলোকবাসীর অদ্ভুত ক্রিয়া দেখে প্ল্যানচেট-চক্র করবার আগ্রহ বাড়বে। এবং যা লিখছি, তা কতখানি সত্যি তা অনুধাবন করতে পারবেন’।

আচার্য ব্রজেন্দ্রলাল শীল স্ত্রীর মৃত্যুর পর জরুরি কাগজপত্র খুঁজে পেয়েছিলেন প্রয়াত স্ত্রীর স্বপ্নে দেখানো ঠিকানায়। জ্যোতিষশাস্ত্রের মতোই প্ল্যানচেটে আস্থা রেখেছিলেন বরেণ্য সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

প্ল্যানচেটের মাধ্যমে প্রয়াত স্ত্রী, গৌড়ির সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং পরবর্তীতে বিদ্যালয়ে প্ল্যানচেটে উৎসাহিদের নিয়ে আসর বসিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন বলে শোনা যায়। এবং জানা গিয়েছে, প্ল্যানচেটের মাধ্যমে মা মৃণালিনী দেবীর কথাতেই না কি, পত্নী বিয়োগের পর, বয়সে সাতাশ বছরের ছোট কল্যাণীকে বিয়ে করেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ একদিকে মোদীর সমালোচনা অন্যদিকে অনুসরণ, মমতার ‘নিজশ্রী’

২০০৫-সালে নিতান্ত কৌতূহলের বশেই হাতে আসে স্বামী অভেদানন্দের লেখা ‘মরনের পারে’। ‘মরনের পারে’ বইটি এখানে অনেকেই পড়েছেন। কিন্তু পড়ার মতো করে হয়ত পড়েছেন খুব কম মানুষ। স্বামী অভেদানন্দ ছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য। ঠিক যেমন স্বামী বিবেকানন্দ।

রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী অভেদানন্দের জন্ম উত্তর কলকাতায়। ২ অক্টোবর ১৮৬৬ সালে। বাবা রসিকলালচন্দ। মা নয়নতারা দেবী। ১৮৮৪-এ স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সঙ্গে আলাপ কালীপ্রসাদ চন্দর। যার সন্ন্যাস জীবনের নাম স্বামী অভেদানন্দ।

আরও পড়ুনঃ আজমল কাসভের একে ৪৭ এর বুলেটের সামনে দুই নার্স

১৮৮৫ সালে ঠাকুরের টানে নিজের বাড়ি ছাড়েন অভেদানন্দ। প্রথমে শ্যামপুকুরের বাড়িতে। পরবর্তীতে কাশিপুর উদ্দ্যানবাটিতে ঠাকুরের শেষ দিন অবধি ছায়াসঙ্গী ছিলেন অভেদানন্দ। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর প্রথমে পাওহারিবাবা, এবং পরে ত্রৈলঙ্গস্বামী ও স্বামী ভাস্করানন্দের সংস্পর্শে আসেন অভেদানন্দ। শুরু হয় প্রেতচর্চা।

১৮৯৬ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে দেশ ছাড়েন অভেদানন্দ। প্রথমে লন্ডন। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, জাপান ও হংকং। দীর্ঘ ২৫ বছর বিশ্ব ভ্রমণ করার পর অভেদানন্দ দেশে ফেরেন ১৯২১ সালে। ১৯২৫ সালে স্থাপনা করেন রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটি যা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ নামে।

‘লাইফ বিয়ন্ড ডেথ’ বা ‘মরনে পারে’ বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন লেখা। অভেদানন্দ মনে করতেন, ‘মৃতদের জীবন সম্পর্কে কথা বলার পরিবর্তে মৃত্যুর পরজীবন সম্পর্কে কী কথা বলা যায় না? আমাদের সকলেরই কম বেশি মৃত্যু সম্পর্কে যেমন কৌতূহল আছে, তেমনই মৃত্যুর পর কী, তা নিয়ে ভুল ধারণা আছে’।

তাঁর মতে, ‘মৃত্যু এক রহস্যময় ঘটনা। মৃত্যু নিয়ে আমাদের ভয় একেবারেই অমূলক। প্রতিটি মানুষের উচিত মৃত্যুকে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা। উচ্চতর আধ্যাত্মিকতা বিশ্বের সর্বধর্মের মূল বিষয়। মৃত্যুর পর আত্মা যখন দেহকে ছেড়ে চলে যায়, তখন তাঁর সাক্ষাৎ হয় ঈশ্বরের দূতের সঙ্গে। আমাদের ধর্মে যিনি সাধক, খ্রিস্টধর্মে তেমনই যিশু। ইসলাম ধর্মে মহম্মদ’।

আরও পড়ুনঃ পরকীয়া সমলিঙ্গে স্লোগান হারিয়ে দিশাহীন এইডস এর প্রচার

অভেদানন্দের মতে, আত্মার ওজন এক চা চামচের এক-তৃতীয়াংশ। তা সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির যা ওজন, আমারও তাই। মৃত্যুর পর আত্মা থাকে অনেকটা ঘুমের স্টেটে। প্ল্যানচেট নিয়ে অনেকেরই বেশ আগ্রহ আছে। প্ল্যানচেট করে আমরা জানতে চাই, আমাদের প্রিয় মানুষেরা কেমন আছেন মৃত্যুর পরে। কবিগুরু প্ল্যানচেট করতেন। একবার নিজের পুত্রের বিদেহী আত্মাকে নামিয়ে এনেছিলেন প্রেতচর্চার মাধ্যমে ।

আরও পড়ুনঃ বিজেপির ‘বাংলা রথ’ এখন দেখার ও সেলফি তোলার অন্যতম আকর্ষণ

কবিগুরুর মতো অভেদানন্দেরও প্রেতচর্চায় দারুণ আগ্রহ ছিল। মাঝে মাঝেই তিনি প্ল্যানচেটের মাধ্যমে স্বামী যোগানন্দের আত্মার সঙ্গে কথা বলতেন। এমনই একটি দিনের ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন,’যোগানন্দের হাতের লেখার সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিলাম আমি। ওর হাতের লেখা দেখেই বুঝতে পারতাম ও-ই এসেছে। একদিন ওর সঙ্গে কথা হতে হতে হঠাতই লেখা বদলে যাওয়া শুরু হল। বেশ কিছুক্ষণ ওই হাতের লেখা চলার পর হঠাৎ থেমে যায়। আমি ভাবছি এমন অজানা ভাষা যোগানন্দ কী করে জানল?’।

এরপর বেশ কয়েক দিন ভাল করে ঘুমাতে পারেননি অভেদানন্দ। অজানা ওই লেখাটি কার এই ভাবনা বারেবারে জমাট বাঁধছিল তাঁর মনে। সযত্নে রাখা কাগজটি নিয়ে একদিন চলে যান, আমেরিকান স্টেট লাইব্রেরিতে। ওখানকার প্রধান গ্রন্থাগারিককে জিজ্ঞেস করেন, এই হাতের লেখাটি তিনি চেনেন কি না! একমাস পর ওই গ্রন্থাগারিক অভেদানন্দকে জানান, হাতের লেখাটি গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের।

আরও পড়ুনঃ Exclusive: ভারতবাসীকে ‘জ্ঞান’ দেওয়া প্রিয়াঙ্কা নিজে কি করলেন

কী ভাবে অভেদানন্দ তা পেলেন, আশ্চর্য হয়ে এও জানতে চান তিনি। সেদিন অবশ্য অভেদানন্দের কাছে কোনও উত্তর ছিল না এই প্রশ্নের। পরবর্তীকালে বুঝতে পারেন,ওই দিন যোগানন্দের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন গ্রিক দার্শনিক।

পাওহারিবাবা, ত্রৈলঙ্গস্বামীর কাছে যেমন প্রেতচর্চা শিখেছিলেন অভেদানন্দ, তেমনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসকালে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করেছেন উনি। গবেষণার ফলই তাঁর বই, ‘মরনের পারে’। বা ‘লাইফ বিয়ন্ড ডেথ’। শুধু মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের কথা তুলে ধরেননি অভেদানন্দ, জানিয়েছেন আরও অনেক অনেক অজানা তথ্য। এবং সমস্তই গবেষণার মাধ্যমে। যেমন এক জায়গায় বলেছেন, পুনর্জন্মের কথা। লিখেছেন,আমরাই নির্ধারণ করি কে হবে আমাদের বাবা ও মা।

আরও পড়ুনঃ কৃষক র‍্যালিকে ঢাল করেই মোদী বিরোধী মঞ্চ গঠনের মরিয়া চেষ্টা বিরোধীদের

তবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথা যেমন একজন স্কুলে না যাওয়া মানুষও বুঝতে পারেন, স্বামী বিবেকানন্দ বা অভেদানন্দের কথা বুঝতে গেলে আপনাকে বইটি একবার না, বেশ কয়েকবার অনুধাবন করতে হবে। যারা অবসাদে ভোগেন, তাঁদের জন্য এই বইটি যে কোনও ওষুধের চেয়ে বেশি কার্যকরী। মানুষের জীবনের দর্শনটাই বদলে যায় এই বইটি অনুধাবন করতে পারলে।

(মত ও বিশ্বাস লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন