কঙ্কালমালিনী কালী, মনোহর ডাকাত আর মনোহরপুকুর রোডের গল্প

1673
কঙ্কালমালিনী কালী, মনোহর ডাকাত, আর মনোহরপুকুর রোডের গল্প/The News বাংলা
কঙ্কালমালিনী কালী, মনোহর ডাকাত, আর মনোহরপুকুর রোডের গল্প/The News বাংলা

দক্ষিণ কলকাতায় গড়িয়াহাট যাবার পথে ট্রাংগুলার পার্ক এর ঠিক পাশেই দেখা যায় একটা ছোট্ট কালীমন্দির। চারদিকে বড় বড় বাড়ির মাঝে সে কোণঠাসা হয়ে গেছে, খুব একটা খেয়াল না করলে চোখেই পরে না এই মন্দির। কালিমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক দুর্ধষ ডাকাত, যার নাম ছিল মনোহর বাগদি।

আরও পড়ুনঃ কেন মা কালীর পায়ের নিচে বাবা মহাদেব

পাথরের কালীমূর্তিটি, ছোট হলেও ভীষণদর্শনা। প্রতিষ্ঠার সময় কোনো অলঙ্কার ছিল না দেবীর গায়ে। দেবী ছিলেন আয়ুধভূষিতা, মুন্ডমালা-বিভূষিতা, আর হাতে ছিল নরবলি হওয়া কোনো হতভাগ্যের করোটি। এই কালীর পূজো প্রতিষ্টা করে, ডাকাত মনোহর বাগদি ও তার দলবল। আজকের দিনেও, এই কালীমন্দিরে গেলে, আপনার গা ছম-ছম করবে।

টুকরো টুকরো জনশ্রুতিতে জানা যায় পলাশীর যুদ্ধের শেষের সময়ে। সেই সময় বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয় নি। চারিদিকে চলছিল অরাজকতা। আর সেই সময়, কালীঘাটসহ দক্ষিণ কলকাতার এই পুরো এলাকাটা ছিল গভীর জঙ্গলে ভরা, আর তার মাঝে বয়ে যেত আদিগঙ্গা। লোকজন কালীঘাট দর্শনের জন্য এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, অথবা নৌকাপথে আদিগঙ্গার উপর দিয়ে আসতো। আর এই জঙ্গলের মধ্যেই ছিল মনোহর ডাকাতের আস্তানা।

আরও পড়ুনঃ নরকঙ্কালের খুলি সাজিয়ে জাগ্রত মহাশ্মশান কালীর পুজো

এরকম সময়ে, এক গভীর রাতে মনোহর ডাকাত দলবলসহ ডাকাতি করে, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফিরছিল তার আস্তানায়। হটাৎ তাদের চোখে পড়ে, একজন মহিলা বাঘের আঘাতে আহত হয়ে খালের কাদায় পড়ে আছে, আর তার পাশে পাঁচ-ছয় বছরের ছেলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তারা তুলে নিয়ে আসে দুজনকে, কিন্তু অনেক সেবা-শুশ্রূষা করার পরেও মহিলার মৃত্যু হয়, আর ছেলেটি বেঁচে ওঠে।

আরও পড়ুনঃ শনি শিগনাপুর গ্রামে দরজাবিহীন বাড়িঘর থাকার কিংবদন্তি কাহিনী

মনোহর ডাকাত মহিলা এবং শিশুদের উপর কোনো অত্যাচার করতো না। তাই ছেলেটিকে নিয়ে সে পড়লো মহা ফ্যাসাদে! কার বাড়ির ছেলে, সেটা খুঁজে বের করতে গেলে মহা বিপদ, আবার এই ছোট ছেলেকে সে রাখেই বা কোথায়! শেষে মনোহর নিজের ছেলের মতো তার দেখভাল করতো, তাকে গল্প শোনাতো, তার জন্য ভালো জামাকাপড় জোগাড় করে নিয়ে আসতো। ছেলেটির আগের স্মৃতি কিছু ছিল না। মনোহর তার নাম দিলো হারাধন।

আরও পড়ুনঃ অজানা কাহিনির আড়ালে সিদ্ধপিঠ তারাপীঠের তারা মা

সন্তানস্নেহ যে মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে, সেটার আর একটা উদাহরণ হলো মনোহর ডাকাত। যত দিন যায়, হারাধনের উপরে মনোহরের স্নেহ আরো বেড়ে চলে। ডাকাতি করার উৎসাহ ক্রমশঃ কমে যেতে থাকে তার। দলের লোকেরা অনেক অনুরোধ করলে, তবে সে এক এক দিন যেত ডাকাতি করতে।

আরও পড়ুনঃ জেনে নিন সিদ্ধপুরুষ ‘জয় বাবা লোকনাথ’ এর অজানা কাহিনী

ধীরে ধীরে হারাধন বড়ো হতে লাগলো, আর মনোহর বৃদ্ধ হতে লাগলো। মনোহরকে একটা চিন্তা সবসময় তাড়া করতো, যে তার পরে হারাধনের কি হবে! এর মধ্যে, ভবানীপুর অঞ্চলে ক্রিশ্চান পাদ্রীরা ছোট ছোট পাঠশালা খুলছিলেন। তারা গরিব-দুঃখী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতেন, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিতেন এবং বাইবেল পড়াতেন। মনোহর তাদের কাছে ছেলেকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিলো। হারাধনের নাম হলো হারাধন বিশ্বাস, বাবা মনোহর বিশ্বাস। মেধাবী হারাধন, খুব যত্ন করে লেখাপড়া শিখতে লাগলো।

আরও পড়ুনঃ শিব ও পার্বতীর বিয়ের অদ্ভুত গল্প (পর্ব ১)

এদিকে দিনে দিনে জরার ভারে মনোহরের শক্তি কমে আসছিল, আগের মতো চলাফেরা করতে পারতোনা সে। অন্যদিকে কোম্পানির শাসন শুরু হয়ে গেছে, তাই চুরি ডাকাতি রাহাজানি কমে আসছিল। মনোহরের দল ভেঙে গেছিলো। এখন হারাধনকে ছেড়ে থাকতে পারতোনা সে এক মুহূর্ত। কিন্তু বিচক্ষণ মনোহর তার পেশার কথা গোপন করেছিল ছেলের কাছে, তাই শেষ জীবনে সে চাষবাস করে আর জমিতে লোক খাটিয়ে, চাষীর মতো জীবন কাটাতো। মনে অনুতাপও জন্মেছিল তার।

আরও পড়ুনঃ শিব ও পার্বতীর বিয়ের অদ্ভুত গল্প (পর্ব ২)

মৃত্যুর আগে, পাওয়া গুপ্তধনের নাম করে, ছেলেকে তিন ঘড়া মোহর আর সোনা-রুপো দিয়ে যায় মনোহর। আরো অনুরোধ করে, তার মৃত্যুর পরে এই এলাকায় যেন হারাধন কয়েকটা দিঘি আর পুকুর কাটিয়ে দেয়। কারণ ওই সময়ে এই এলাকায়, গরমের সময় খুব জলকষ্ট ছিল। হারাধন, বাবার মৃত্যুর পরে, সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। মনোহরপুকুর সংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি বড়ো পুকুর ও দিঘি কাটিয়ে দিয়েছিল সে। আজ সেগুলোর অনেকগুলো বুজে গেছে, আর কয়েকটা অসংস্কৃত অবস্থায় আছে।

আজকে মনোহরও নেই, আর হারাধনও নেই। কিন্তু তাদের স্মৃতি ও কীর্তি অমর করে রেখেছে, সাউথ কলকাতার একটি রাস্তা, যার নাম মনোহরপুকুর রোড। গল্প জানার পর এবার ঘুরে দেখে আসুন সেই রাস্তা আর মন্দিরটি।

আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে The News বাংলা পড়তে লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন