একেই বলে বাংলার রাজনীতি। যেখানে বেঁচে থাকা মানুষের চেয়েও কখনও মৃতদেহ অনেক দামি হয়ে ওঠে। ঠিক সেটাই আবার হল মতুয়া মহাসংঘের বড়মা বীণাপাণি দেবীর সঙ্গেও। মরে গিয়েও তৃণমূল বিজেপির হাত থেকে রেহাই পেলেন না বড়মা। টানাটানি চলল তাঁর নশ্বর দেহ ঘিরে।
দুই বাংলার মতুয়ারা মাতৃহারা হয়েছেন। ভারত ও বাংলাদেশের একেশ্বরবাদী মতুয়া মহাসংঘের বড়মা বীণাপাণি দেবী মঙ্গলবার রাত ৮টা ৫২মিনিট নাগাদ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার রাতেই তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে বিকল হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন ডাক্তাররা। বড়মার মৃত্যুতে দুই বাংলার মতুয়া সমাজে শোকের ছায়া। শোকের মধ্যেই তীব্র রাজনীতি তৃণমূল বিজেপির।
আরও পড়ুনঃ দুই বাংলার মতুয়ারা মাতৃহারা হলেন
এতদিন বড়মা বীণাপাণি দেবী ছিলেন তৃণমূলের একচেটিয়া। গত ২ ফেব্রয়ারি ঠাকুরনগরের বড়মার বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপর থেকেই বেড়ে যায় লড়াই। বড়মা তথা মতুয়া ভোট পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সমীকরণের বড়সড় প্রভাব ফলতে পারে। সে কারণেই রাজ্যের প্রধান দুটি দলই চায় মতুয়ারা তাদের সঙ্গে থাকুন। এর জেরেই মরার পরেও তৃণমূল বিজেপির হাত থেকে রেহাই পেলেন না বড়মা।
মতুয়া সম্প্রাদায়ের বড়মা বীণাপাণিদেবীর মৃত্যুতে ঠাকুর পরিবারের রাজনৈতিক বিভাজনের চিত্র একেবারে প্রকাশ্যে চলে এল। বড়মা-র শেষকৃত্য নিয়ে দুদিন ধরে দুপক্ষের মধ্যে চলল চরম কাদা ছোড়াছুড়ি। চিৎকার, চেঁচামেচি, উত্তেজনা, ঠেলাঠেলি, খুনের অভিযোগ কিছুই বাদ গেল না এই পর্বে।
আরও পড়ুনঃ এই প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রাজ্যের অ্যাসিড আক্রান্তরা
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বীণাপাণিদেবীর মৃত্যু থেকে দাহ ঘিরে যা যা ঘটল, সেই ঘটনা পরাম্পরার একটাই উদ্দেশ্য মতুয়া ভোট ব্যাঙ্ক। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বঁনগা লোকসভা আসন দখলের যে লড়াই হতে চলেছে, তারই একটা ঝলক দেখা গেল বৃহস্পতিবার ঠাকুরবাড়িতে। বিগত দুদিন ধরে একদিকে যেমন তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী-নেতারা মাটি আঁকড়ে পড়ে রইলেন, তেমনি মুহূর্তের জন্য ময়দান ছাড়ল না বিজেপি নেতৃত্বও।
বড়মার পরিবার এখন তৃণমূল-বিজেপির টানাটানিতে বিভক্ত। ঠাকুর পরিবারের নানা সদস্যের নেতৃত্বেই বিভাজিত হয়ে গিয়েছে সাধারন মতুয়াদের একটা বড় অংশ। তবে এসবের মধ্যেও অনেকেই আবার বড়মার মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতির বিরোধিতাও করেছেন সরবে। এই ‘লাশের রাজনীতি’ নিয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ ঠাকুরনগরের বাসিন্দারাও।
আরও পড়ুনঃ ডিএ মামলায় হাইকোর্টে ফের মুখ পুড়ল রাজ্য সরকারের
দাহকার্যের সময় একদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মন্ত্রী সুজিত বসু, সাংসদ ইদ্রিশ আলি, নির্মল ঘোষ হাজির ছিলেন। অন্যদিকে বিজেপি নেতা মুকুল রায়, রাহুল সিনহারাও এসেছেন ঠাকুরবাড়িতে। কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও চলল চিৎকার, চেঁচামেচি, উত্তেজনা, ঠেলাঠেলি। লাশের রাজনীতি কেমন করে করতে হয় বোঝাল লক্ষ্মীবারের ঠাকুরবাড়ি।
বড়মার মৃত্যুর পর চরম রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির সাক্ষী রয়ে গেল গাইঘাটার ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি। মৃতদেহ নিয়ে রাজনৈতিক দড়ি টানাটানিতে বিলম্বতি হল বড়মার শেষকৃত্যও। প্রথম থেকেই এলাকা জুড়ে ছিল কড়া পুলিশি নিরাপত্তা। রাজ্য সরকার গান স্যালুট দিয়ে সম্মান জানিয়েছে। অন্যদিকে ফের মৃত্যু রহস্যজনক দাবি তুলে সাড়া ফেলে দিয়েছেন শান্তনু ঠাকুর।
আরও পড়ুনঃ মতুয়াদের বড়মার মৃত্যু রহস্যজনক, চাঞ্চল্যকর অভিযোগ
ইতিমধ্যে ঠাকুর পরিবারের উত্তরাধিকার নিয়ে টানাপোড়েনও শুরু হয়ে গিয়েছে। যারা নাগরিকত্ব দেবে তাদের পাশেই থাকবে মতুয়ারা, এই স্লোগানও উঠেছে ঠাকুরবাড়ির অন্দরে। কোন দল ভেকধারী সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই। এভাবেই একদিকে বড়মার মৃতদেহ, আর অন্যদিকে দুদল ‘রাজনৈতিক মতুয়া’ ভক্তদের নির্লজ্জ ঝগড়ার সাক্ষী থাকল ঠাকুরনগর।
রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এদিন বলেন, “এই রাজনীতি একেবারে কাম্য নয়। ঠাকুরপরিবারের সদস্যদের উচিত একসঙ্গে বসে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া। বড়মা জীবন্ত ঠাকুর ছিলেন”। বিজেপি নেতা মুকুল রায় বলেন, “ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বড়মা ডাক দিলেই আমি এখানে চলে আসতাম। আমার সাংসদ কোটার টাকা এখানকার উন্নয়নে বরাদ্দ হয়েছিল”।
এবারও এই লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হচ্ছেন গতবারের সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরই। আর বিজেপির প্রার্থী হওয়ার কথা রয়েছে ওই পরিবারের বড়মার নাতি শান্তনু ঠাকুরের। লোকসভা দখলের লড়াই এর আগেই বড়মার মৃতদেহ দখলের লড়াই দেখে নিল গোটা রাজ্য।